কলকাতা, 17 জুন : মুকুল রায়কে বিধায়ক পদে ইস্তফা দেওয়ার জন্য সোমবার 24 ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী ৷ বলেছেন, ওই সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করলে তিনি 'ব্যবস্থা' নেবেন ৷
ওদিকে শুভেন্দু'র হুমকিকে একটুও গুরুত্ব না দিয়ে কৃষ্ণনগর-উত্তরের বিধায়ক মুকুল রায় বুঝিয়েছেন, এখনই তিনি বিধায়ক পদ ছাড়ছেন না, ছাড়ার কথা ভাবছেনও না ৷ উল্টে তাঁকেই না কি বিধানসভায় বড় দায়িত্ব দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে তৃণমূল ৷ হয়ত তিনিই হবেন গুরুত্বপূর্ণ 'পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি'র চেয়ারম্যান ৷ যদিও এ বিষয়টি এখনও জল্পনার স্তরে রয়েছে ৷
এই আবহে বাংলার রাজনৈতিক মহল এখন চরম কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে শুভেন্দু অধিকারীর দিকে ৷ তিনি ঠিক কেমন করে, কোন আইনে মুকুল রায়ের বিধায়ক পদ খারিজ করেন, সেই দিকে ৷ আইনি মহলের মতে, এই পরিস্থিতিতে মুখরক্ষায় শুভেন্দু স্রেফ একটি চিঠি দিতে পারেন রাজ্য বিধানসভার স্পিকারকে ৷ ওই পর্যন্তই ৷ এর পর গোটা খেলাটাই চলে যাবে স্পিকারের হাতে ৷ মাঝে মধ্যে স্পিকারকে চিঠি লিখে 'তাগাদা' দেওয়া আর সংবাদমাধ্যমের সামনে 'দেখে নেব' বলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না ৷ ওদিকে মুকুল রায়ও থেকে যাবেন বিধায়ক পদে, বিধানসভা অধিবেশনে মাঝে দেখাও হতে পারে দু'জনের ৷ বিধায়ক পদ খারিজ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ ৷
আরও পড়ুন,Partha-Suvendu : বিধানসভার কমিটি গঠন নিয়ে আলোচনায় পার্থ-শুভেন্দু
গত 10 বছর এ রাজ্যে দলত্যাগ-বিরোধী আইনের কোপে দলবদলু কোনও বিধায়ককেই সদস্যপদ খোয়াতে হয়নি ৷ তাহলে এতখানি উঁচিয়ে কেন খেলতে গেলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা? দিল্লির 'গুডবুকে' থাকতেই সুর চড়িয়েছেন? নাকি এই হুমকি দিয়ে তিনি তৃণমূলে যোগ দিতে যাওয়া বিজেপি বিধায়কদের লাইন ছত্রভঙ্গ করতে চাইছেন ? এর একটিও কি কার্যকরী হবে ? শুধু হুমকিতেই সন্তুষ্ট হবেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা? দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি এই বাজারে দল ছেড়ে 'শত্রুপক্ষে' যোগ দিয়েছেন ৷ বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের মুখে দলের এই 'বিজ্ঞাপন' যে বিপক্ষে যাবে, তা বেশ বুঝতে পারছে গেরুয়া-শীর্ষস্তর ৷ অথচ সমুখসমরে কিছুই করা যাচ্ছে না ৷ আইন সেইভাবে পক্ষে নেই ৷ তাহলে বিরোধী দলনেতা কোন পথে তুষ্ট করবেন দিল্লিকে?
দ্বিতীয়ত, এক দলত্যাগীর বিধায়ক পদ খারিজ করার হুমকি দিয়ে দলের অন্য বিধায়কদের ফুলবদল ঠেকানো নেহাতই কষ্টকল্পনা ৷ শাসক দল চাইলে এবং এই প্রক্রিয়ায় স্পিকার সঙ্গে থাকলে যে কোনও দলের বিধায়ক বা সাংসদকে যখন-তখন নিজের দলে যে আনা যায়, সেই অভিজ্ঞতা তো একসময়ের তৃণমূলী শুভেন্দুবাবুর আছে৷ সেই সময়ে একাধিক কংগ্রেস বিধায়ককে তিনি তৃণমূলে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ তৎকালীন বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান 'পিলার টু পোস্ট' দৌঁড়েছিলেন ওই বিধায়কদের সদস্যপদ খারিজ করার জন্য ৷ কোনও লাভই হয়নি ৷ বিধানসভার স্পিকারকে টলাতেই পারেননি মান্নান ৷ ওই দলবদলুরা পূর্ণ সময় বিধায়ক ছিলেন ৷ তাহলে? এমন হুমকি'র পরিণতি কী?
আরও পড়ুন,মুকুলের বিধায়ক পদ খারিজের দাবিতে কাল স্পিকারের দ্বারস্থ হচ্ছে বিজেপি
কোনও দলত্যাগী বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ করার আইন অবশ্যই আছে ৷ সেই আইন যথাযথ এবং নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করা একান্তই জরুরি ৷ কারণ, দলবদলু প্রতিটি জনপ্রতিনিধির পিছনে হাজার হাজার ভোটারের সমর্থন রয়েছে ৷ একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতীকের প্রার্থীকেই তাঁরা সমর্থন করেছেন ৷ নির্বাচিত হয়ে কোনও বিধায়ক অন্য দলে যোগ দেওয়ার অর্থ, ওই হাজার হাজার ভোটারের সঙ্গে প্রতারণা করা ৷ যে কোনও রাজনীতিক যখন ইচ্ছা দলবদল করতেই পারেন ৷ কিন্তু একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দলবদল করতে চাইলে তাঁকে নির্বাচিত পদে ইস্তফা দিতেই হবে ৷ কারণ তিনি যে কেন্দ্রের নির্বাচিত প্রতিনিধি, সেই কেন্দ্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা, ওই প্রতিনিধি দলবদল করে যে দলে যোগ দিলেন, সেই দলকে সমর্থন করেননি ৷ নির্বাচিত হয়ে দলবদল করলে, ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা করা হয় ৷ দলবদলুরা এই বিষয়টি জানলেও তা পাত্তা দেন না ৷
অ্যান্টি ডিফেকশন ল কার্যকর হলে দলবদলু বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ হবেই ৷ কিন্তু তা হচ্ছে কোথায় ? না হওয়ার কারণ, ওই আইন কিছুটা প্রতিবন্ধী ৷ আইনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বিধানসভা বা লোকসভার স্পিকারকেই দেওয়া হয়েছে ৷ এবং আইনে এমন কোনও বাধ্যকতা নেই, যে এই অভিযোগ তুললে বা দাবি জানালে স্পিকার দ্রুততার সঙ্গে দলবদলুদের বিধায়ক পদ খারিজ করতে বাধ্য ৷ তেমনই যদি হত, তাহলে গত 10 বছরে দলবদল করা বিধায়কদের একজনেরও সদস্যপদ থাকত না ৷ এদের অনেকেই আবার শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরেই সেই সময়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন ৷ আইনের ফাঁক খুঁজে সেদিন শুভেন্দুই এদের 'রক্ষা' করেছিলেন ৷ দলবদল করেও তো দিব্যি বিধায়ক ছিলেন,
- হাসানুজ্জামান শেখ (কালীগঞ্জ)
- অরিন্দম ভট্টাচার্য (শান্তিপুর)
- শংকর সিংহ (রানাঘাট উঃপঃ)
- তুষারকান্তি ভট্টাচার্য (বিষ্ণুপুর)
- শম্পা দরিপা (বাঁকুড়া)
- বিশ্বনাথ পড়িয়াল (দুর্গাপুর পশ্চিম)
- কানাইলাল আগরওয়াল (ইসলামপুর)
- গৌতম দাস (গঙ্গারামপুর)
- সমর মুখোপাধ্যায় (রতুয়া)
- সাবিনা ইয়াসমিন (মোথাবাড়ি)
- আখরুজ্জামান (রঘুনাথগঞ্জ)
- আশিস মারজিৎ (খড়গ্রাম)
- শাঁওনি সিংহ রায় (মুর্শিদাবাদ)
- অপূর্ব সরকার (কান্দি)
- আবু তাহের খান (নওদা)
- রবিউল আলম চৌধুরি (রেজিনগর)
- কাজি আব্দুর রহিম দিলু (বাদুড়িয়া)
- উইলসন চম্পামারি ( কালচিনি)
- সব্যসাচী দত্ত (রাজারহাট- নিউটাউন)
- শুভ্রাংশু রায় ( বীজপুর)
- সুনীল সিং ( নোয়াপাড়া)
- দুলাল বর ( বাগদা)
- বিশ্বজিৎ দাস( বনগাঁ-উত্তর)
- শোভন চট্টোপাধ্যায় ( বেহালা পূর্ব)
- দেবেন্দ্রনাথ রায় (হেমতাবাদ) (প্রয়াত) ৷
আরও দুই-চারজন থাকলেও থাকতে পারেন, এখন মনে পড়ছে না ৷ এই তালিকার দু-একজন অবশ্য লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কারণে বিধায়ক-পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন ৷ লোকসভা নির্বাচনেও পরাস্ত হন ৷ ফলে তাঁরা শেষ পর্যন্ত আর বিধানসভার সদস্য ছিলেন না ৷
সেদিনও যে আইন ছিল, আজও সেই আইনই আছে ৷ সেদিন শাসক পক্ষে ছিল তৃণমূল, আজও তাই ৷ সেদিনও যিনি স্পিকার ছিলেন, আজও তিনিই স্পিকার ৷ সেদিনের বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান এই চেষ্টা করেও যে আইনের ফাঁকে ফেঁসেছিলেন, এখনকার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী কোন যাদুবলে সেই ফাঁক ভরাট করেন, সেদিকেই কৌতূহলী নজর রাজ্যের রাজনৈতিক মহলের ৷ কারণ, শুভেন্দু চড়া সুরেই বলেছেন, "বিরোধী দলনেতা হিসেবে বাংলায় এই আইন কার্যকর করেই ছাড়ব আমি ।’’
আরও পড়ুন,শুভেন্দুর চ্যালেঞ্জের জবাব, বিধায়ক পদ এখনই ছাড়ছেন না মুকুল
এদিকে দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞদের ব্যাখা,
- দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন একমাত্র স্পিকার ।
- কার বিরুদ্ধে এবং কবে স্পিকার পদক্ষেপ করবেন সে সবই একমাত্র তাঁর সিদ্ধান্তের উপরেই নির্ভর করছে ।
- এ বিষয়ে স্পিকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও সময়সীমার কথা বলা নেই ।
- বিধানসভা এবং লোকসভা, দু'ক্ষেত্রেই বিষয়টি স্পিকারের উপরই নির্ভর করছে ৷
- এই আইন কার্যকর করার বিষয়ে রাজ্যপাল তো ননই, রাষ্ট্রপতিরও কিছু করণীয় নেই । স্পিকারই শেষ কথা বলবেন ।
- 1985 সালের দলত্যাগ বিরোধী আইনে স্পষ্ট বলা আছে, স্পিকারই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী ৷
- স্পিকার চাইলে বিষয়টি বিধানসভার প্রিভিলেজ কমিটির কাছে পাঠাতে পারেন । তবে তা স্পিকার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে৷ এ বিষয়ে আইনে বাধ্যবাধকতার উল্লেখ নেই ।
- এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য স্পিকারকে নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমাও দেওয়া নেই ।
- স্পিকার কবে সিদ্ধান্ত নেবেন অথবা আদৌ সিদ্ধান্ত নেবেন কি না, আইনের প্রতিটি ধাপেই শেষ কথা বলার অধিকার একমাত্র স্পিকারকেই দেওয়া আছে৷
- স্পিকার যতক্ষণ না কোনও সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন, ততক্ষণ দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর করার জন্য আদালতেও যেতে পারবে না কোনও পক্ষ ।
- স্পিকারের সিদ্ধান্ত অপছন্দ হলে কোনও পক্ষ আদালতে যেতে পারে ৷
- তবে স্পিকার যদি একটি ‘যুক্তিগ্রাহ্য’ সময়ের বেশি ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকেন, তা হলে আদালতে আবেদন করা যেতে পারে । সেক্ষেত্রে কোনও ‘যুক্তিগ্রাহ্য’ কারণ দেখানো স্পিকারের পক্ষে কঠিন কোনও কাজ নয় ৷
- আদালত এই ইস্যুতে একদমই হস্তক্ষেপ করতে পারবে না অথবা আদালতে আবেদন করা যাবে না, বিষয়টা তেমন নয় । তবে আদালতের হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রটি খুবই সীমিত ৷
সংবিধানের 52তম সংশোধনে এই আইনের যে ব্যাখা রয়েছে এবং এই আইনের যে ধরনের প্লাস-মাইনাস রয়েছে, সে সব বিজেপি'র বা বিরোধী দলনেতার অজানা থাকার কথা নয় ৷ এটাও স্পষ্ট, দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রয়োগ করে রাজ্যে এই মুহূর্তে শাসক দলের কোনও বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ করা সহজ কোনও কাজ নয় ৷ চড়া সুরে হুমকি দেওয়া বরং অনেক সহজ ৷