কলকাতা, 31 জানুয়ারি : কার ঘোড়া কে নেবে ? এই চলছে এখন বাংলার রাজনীতিতে । একদিকে তৃণমূলের সাজানো ঘর ভাঙছে, আর সেই ঘর-ভাঙা ঘোড়াদের নিয়ে নিজেদের ঘর সাজিয়ে তুলছে বিজেপি । ভোটের আগে শাসকদলকে যতটা সম্ভব দুর্বল করা যায় সেই চেষ্টাতেই উঠেপড়ে লেগেছেন দিলীপ-কৈলাসরা । বাংলার ইতিহাসে এই ট্রেন্ড অচেনা হলেও ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতি অন্য রাজ্যগুলিতে আকছাড় চলে আসছে ।
খুব বেশি পিছনে যেতে হবে না । 2019 সাল । কর্নাটকের তখতে তখন কংগ্রেস আর জনতা দল সেকুলারের জোট সরকার । হঠাৎ শাসক শিবিরের একের পর এক নেতা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন । বিধায়কদের ইস্তফার হিড়িক পড়ে যায় । গদি পালটে যাওয়ার জোগাড় । পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে 75 জন বিধায়ককে বেঙ্গালুরুর বাইরে এক রিসর্টে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল কংগ্রেস । কংগ্রেসের তরফে অভিযোগ আনা হয়েছিল, মোটা টাকার টোপ দিয়ে ঘোড়া কেনাবেচার ছক কষছে বিজেপি ।
পরে জানা গিয়েছিল, ঈগলটন রিসর্টে রাখা হয়েছিল বিধায়কদের । এই ঈগলটন রিসর্টেরও ইতিহাস রয়েছে । বিজেপির হাত থেকে নিজেদের বিধায়কদের সামলে রাখতে কংগ্রেস এর আগেও শরণাপন্ন হয়েছিল এই রিসর্টের । 2017 সালে রাজ্যসভা ভোটের আগে গুজরাত থেকে কংগ্রেস বিধায়কদের এনে রেখে দেওয়া হয়েছিল এখানে । কোটি কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগ উঠেছিল তখনও । সংবাদমাধ্যমের একাংশের প্রকাশ, গুজরাতের 6 কংগ্রেস বিধায়ককে কিনতে 65 কোটি টাকা খরচ করেছিল বিজেপি ।
অভিযোগ উঠেছিল রাজস্থানেও । অশোক গেহলত ও সচিন পাইলটের মধ্যে যখন দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেই সময় কংগ্রেসের সরকার ফেলে দিতে বিধায়কদের 10-15 কোটি টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল বিজেপির বিরুদ্ধে ।
আরও পড়ুন : একুশের নির্বাচন মমতা বনাম শুভেন্দু ?
কিন্তু বাংলার ছবিটা অনেকটাই আলাদা । একের পর এক নেতা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে চলে যাচ্ছেন । কিন্তু কোথাও মোটা টাকার টোপ দেওয়ার অভিযোগ উঠছে না । বরং দেখে মনে হচ্ছে দলের কাজে বীতশ্রদ্ধ হয়ে 'মানুষের জন্য' কাজ করতে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন তাঁরা । তৃণমূল নেত্রী মাঝেমধ্যে মোটা টাকার টোপ দিয়ে ঘোড়া কেনাবেচার অভিযোগ তুলছেন বটে তবে সেই অভিযোগে মমতা-সুলভ ধারটা যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । বরং বেশি করে উঠে আসছে যে তত্ত্বটি, তা হল নেতাদের নাকি ইডি-সিবিআই-এর ভয় দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । কয়েকদিন আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে শোনা গিয়েছিল, চিটফান্ডকাণ্ড নিয়ে তৃণমূলের নেতা এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে । বিজেপিতে যোগ না দিলে নাকি তাঁদের জেলে ভরার হুমকি দেওয়া হচ্ছে ।
যাঁরা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন তাঁদের নিয়ে কী বলেছিলেন মমতা ? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তৃণমূলনেত্রীর এই অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন নয় । এই ঘর ভাঙানোর খেলা শুরু হয়েছিল মুকুল রায়কে দিয়ে । সারদা থেকে নারদা... একের পর এক কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছিল তৃণমূলের তৎকালীন সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের । সিবিআই বেশ কয়েক দফায় তলবও করে তাঁকে । নারদার স্টিং অপারেশনে সাংসদকে টাকা নিতে দেখা না গেলেও তাঁকে ভিডিয়ো ফুটেজে দেখা গিয়েছিল । আজ তিনি বিজেপিতে । এখন সর্বভারতীয় সহ সভাপতি । এক সময়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডাকেও দেখা গিয়েছিল সেই ফুটেজে । আজ তিনিও বিজেপি নেতা । সেই তালিকায় রয়েছে শোভন চট্টোপাধ্যায়ও । নারদার ভিডিয়োয় হাত পেতে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে ।
আরও পড়ুন : দুর্নীতি-তোলাবাজির প্রমাণ দিন, ফাঁসির কাঠে যাব, শুভেন্দুকে চ্যালেঞ্জ অভিষেকের
এখন যিনি বিজেপির পোস্টার বয়, সেই শুভেন্দু অধিকারীকেও দেখা গিয়েছিল নারদার স্টিং অপারেশনে । ভিডিয়ো ফুটেজে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল নন্দীগ্রামের ভূমিপুত্রকে । আর তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরপরই রাজ্য বিজেপির ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় নারদা স্টিং অপারেশনের ভিডিয়ো ।
নারদাকাণ্ডে যাঁদের নাম জড়িয়েছিল, তাঁরা এখন কে কোথায় রয়েছেন ? রাজনৈতিক দিক থেকে দেখতে গেলে অধিকারী পরিবারকে হেভিওয়েটদের তালিকায় ফেলতে গেলে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয় । একই পরিবার থেকে একই সময়ে দু'জন সাংসদ, একজন রাজ্যের মন্ত্রী হওয়ার ছবি বাংলার ইতিহাসে বিরল । এই পরিস্থিতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার শুভেন্দুকে যে ঘুষখোর বলে অভিযোগ করেছেন, তাও খুব একটা অমূলক নয় বলেই মনে করছেন রাজ্য রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা । অধিকারীদের ফুলে-ফেঁপে ওঠা সম্পত্তির দিকে তাকালে অনেকেই এমন মনে করতে পারেন । গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থীদের সম্পত্তির হিসাব অনুযায়ী সেই সময় শুভেন্দুর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল 62 লাখ 60 হাজার টাকা । 2019 সালের লোকসভা ভোটের সময় শিশির অধিকারীর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল 3 কোটি 39 লাখ 79 হাজার টাকা । 2014 সালের লোকসভা ভোটের সময় এই সম্পত্তির পরিমাণ ছিল 1 কোটি 94 লাখ 98 হাজার টাকা । 2019 সালে ভোটের সময় দিব্যেন্দু অধিকারীর সম্পত্তি ছিল 3 কোটি 76 লাখ 87 হাজার টাকা । 2016 সালে উপনির্বাচনে লড়ার সময় দিব্যেন্দুর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল 1 কোটি 82 লাখ 24 হাজার টাকা । খাতায়-কলমে যে হিসাব রয়েছে, তা থেকে বোঝাই যাচ্ছে, কত দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে অধিকারী পরিবারের সম্পত্তি । বিজেপি বিরোধী শিবিরের অনেকেই বলছেন, এই বিশাল অঙ্কের সম্পত্তির অনেকটাই কালো টাকা । তবে এই বিশাল অঙ্কের টাকা সামলে রাখতেই কি গেরুয়া শিবিরে নাম লেখালেন শুভেন্দু ? প্রশ্নটা তুলছেন অনেকেই ।
অধিকারীদের সম্পত্তির খতিয়ান, বিগত কয়েক বছরে কতটা বেড়েছে সম্পত্তি ? আরও পড়ুন : "লিফট-প্যারাসুট ছাড়াই" চড়াই-উতরাই, ঘাসফুলে শুভেন্দু-সফর
মুকুল রায়েরও সম্পত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে । মুকুল রায় ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ডিটেল, সম্পত্তির হিসাব এবং 2017-18 ও 2019-20 আর্থিক বছরের আয়কর রিটার্নের তথ্য চেয়েছিল ইডি । তবে কি সিবিআইকে এতটাই ভয় পাচ্ছেন বাংলার নেতারা ? তবে কি সারদা-নারদা কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচতেই জার্সিবদলের পালা শুরু হয়েছে বাংলায় ? মুখ্যমন্ত্রীর 'ওয়াশিং পাউডার ভাজপা' তকমা কি তবে সত্যি ? এই প্রশ্নই এখন ঘোরাফেরা করছে রাজ্য রাজনীতির আনাচে কানাচে । রাজ্যের বিরোধী দলগুলি কিন্তু এই বিষয়ে শাসক দলের পাশে দাঁড়িয়েছে ।
গোবলয়-সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে মোটা টাকার বিনিময়ে বিধায়ক, সাংসদ কেনাবেচা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন বিরোধীরা । মূল অভিযোগের তির কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপির দিকে । এরাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে নজিরবিহীনভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বিধায়ক, সাংসদ বিজেপিতে চলে যাচ্ছেন । কিন্তু কেন এই দলবদল ? সিপিএম বা কংগ্রেস নয় । দল বদলে সব বিজেপিমুখী । বিরোধীরা মনে করছেন, অর্থ এবং দুর্নীতির টাকা রক্ষা করতেই বিজেপিতে যাচ্ছেন নেতা ও মন্ত্রীরা ।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান বলেন, অন্য রাজ্যে টাকার খেলা হলেও এমনটা মনে করার কারণ নেই যে এরাজ্যে টাকা ছাড়াই সব দল বদল করে বিজেপিতে যাচ্ছে । তিনি বলেন, "মিথ্যা মামলা এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাত থেকে বাঁচতেই সব দল বদল করছে । ইডি, সিবিআইয়ের ভয়ে তৃণমূলের বিধায়ক, মন্ত্রীরা দল ছাড়ছেন । সেই সঙ্গে কেউ কেউ টাকাও পেয়েছেন বিজেপির থেকে ।"
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন," পদের লোভেও কেউ কেউ বিজেপিতে গিয়েছেন । তৃণমূল কংগ্রেসে থাকার সময় যাঁরা প্রচুর টাকা কামিয়েছেন বেআইনিভাবে । সেই টাকাই বাঁচাতে এখন বিজেপিতে আশ্রয় নিচ্ছেন । সেই সঙ্গে সিবিআইয়ের ভয় তো রয়েছেই । ইদানিংকালে যাঁরা বিজেপিতে গিয়েছেন, তাঁরা টাকা বাঁচাতে এবং তল্লাশি থেকে বাঁচার জন্যেই দল বদল করেছেন । বিজেপিতে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকাও পেয়েছেন অনেকেই ।"
আরও পড়ুন : শুভেন্দুময় অমিত-সভা, 'তোলাবাজ ভাইপো' হটিয়ে বাংলা বদলের ডাক
নারদাকাণ্ডে নাম জড়িয়েছে এমন বহু প্রথম সারির নেতা অবশ্য এখনও ঘাসফুলেই রয়েছেন । যেমন সৌগত রায়, কাকলি ঘোষদস্তিদার, ফিরহাদ হাকিম থেকে শুরু করে অনেকেই । তাঁদের দাবি, নারদার স্টিং অপারেশেনের ভিডিয়ো ভুয়ো ।
এদিকে কয়েকদিনআগেই তৃণমূল যুব কংগ্রেস নেতা বিনয় মিশ্রর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছিল সিবিআই । শোনা যায়, এই বিনয় মিশ্র নাকি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশ ঘনিষ্ঠ ।
সারদা-নারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্তদের দলে নেওয়া হলেও দিলীপ ঘোষ প্রথম থেকেই বলে আসছেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে কাউকে রেয়াত করা হবে না । তবে ভোটের ময়দানে ঘাসফুল শিবিরের সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় টক্কর দিতে হলে শুভেন্দু-মুকুলদের কদর ভালোই বোঝেন দিলীপ-কৈলাসরা । তাই সিবিআই-ইডি জুজুকে তারা কাজে লাগাচ্ছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের ।