কলকাতা, 21 নভেম্বর : COPD-তে আক্রান্ত হওয়া মানে, গোটা জীবন এই অসুখটিকে বয়ে নিয়ে চলা । একবার এই অসুখ কারও হল মানে, এই অসুখ তাঁর সঙ্গে সারা জীবন থেকে যাবে । এই অসুখে শ্বাসনালী ক্রমে আরও বেশি সংকুচিত হয়ে পড়তে থাকে । খুব বাড়াবাড়ি হলে আক্রান্তকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হতে পারে । সেক্ষেত্রে প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় । COPD আসলে কী? কেন হয়? কীভাবে এই অসুখ থেকে দূরে থাকা সম্ভব? এসব নিয়ে বলেছেন চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী ।
COPD আসলে কী?
COPD অর্থাৎ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজ়িজ় । ক্রনিক কথাটির অর্থ সঙ্গে থাকে, বহুদিন । অর্থাৎ, এমন নয় যে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মতো কিছু দিন হল, তারপর রোগ সেরে গেল । যিনি COPD-তে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর সঙ্গে এটা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থেকে যায় । অবস্ট্রাক্টিভ অর্থাৎ, একটি অবস্ট্রাকশন । অর্থাৎ ফুসফুসের মধ্যে হাওয়া চলাচলের পথে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে । এবং, এই বাধাটি সঙ্গে থেকে যাচ্ছে । এজন্য এটা ফুসফুসের একটি ক্রনিক অবস্ট্রাকশন । কেন এমন হচ্ছে? আমাদের শ্বাসনালীর দু'টি অংশ আছে । একটি হল এয়ার ওয়ে, যেটা মুখের মধ্যে থেকে গলা দিয়ে নেমে দু'দিকে ভাগ হয়ে ফুসফুসের ডান এবং বাম দিকে পৌঁছেছে । এরপরে এই দু'টি ভাগ আরও বিভিন্ন ভাগ হয়ে ফুসফুসের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছেছে । ফুসফুস আসলে কয়েক লাখ বেলুন একসঙ্গে থাকার মতো । ফুসফুসের একটি অংশ এয়ার ওয়ে । এই অংশটি সংকীর্ণ হয়ে যায় । এর ফলে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দু'টি ক্ষেত্রেই বাধা থাকে । শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলে যথেষ্ট অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করছে না । আর, শ্বাস ছাড়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হলে শরীরের মধ্যে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছিল, সেটা পুরোটা বের হতে পারছে না । COPD আক্রান্তের সমস্যা যখন বেড়ে যায় তখন এক্ষেত্রে বেশি সমস্যা তৈরি হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড পুরোপুরি বের হতে না পারার জন্য । অ্যাজ়মায় আক্রান্তদের শ্বাসনালীও সংকীর্ণ হয়ে যায় । তবে তাঁদের শ্বাসনালী আবার স্বাভাবিক অবস্থার কাছাকাছি চলে আসতে পারে । COPD আক্রান্তদের ক্ষেত্রে শ্বাসনালী সংকীর্ণ হওয়ার বিষয়টি ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে । সমস্যা যখন বেড়ে যায় তখন এক ধাক্কায় শ্বাসনালী অনেকটা সংকুচিত হয়ে যায় । এক্ষেত্রে কিছুটা পুনরুদ্ধার সম্ভব । কিন্তু, আগের স্বাভাবিক অবস্থায় কখনও ফিরে আসে না ।
কেন হয় COPD?
সাধারণত ধোঁয়া এবং ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা বিভিন্ন ধরনের অক্সাইড থেকে COPD হয় । যাঁরা ধূমপান করেন, সালফার এবং কার্বনের অক্সাইড, মনোক্সাইড, ডাই অক্সাইডের সঙ্গে ধোয়া তাঁদের ফুসফুসে ঢুকছে । ধোঁয়ার মধ্যে অনেক পরিমাণে কার্বন রয়েছে । কেউ হয়তো ধূমপান করেন না । কিন্তু, তাঁর আশপাশে কেউ ধূমপান করলে, সেই ধোঁয়া তাঁর শরীরে প্রবেশ করছে । কেউ হয়তো অনেক সময় ধরে উনুন জ্বালিয়ে কাজ করেন, এমন উনুন যাতে অনেক ধোঁয়া হয় । এসব ক্ষেত্রেও COPD হতে পারে । আগে মনে করা হত, COPD শুধুমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি হয় । এখন এদেশে দেখা যাচ্ছে, COPD-তে মহিলারাও বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন । এই সব আক্রান্তের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে COPD ধরা পড়ে না, কারণ রোগ নির্ণয় করা হয় না । গ্রামের দিকে এমন অনেক বাড়ি রয়েছে যেখানে পুরুষরা মাঠে কাজ করছেন, আর মহিলারা ঘরে কাজ করছেন । ওই সব পুরুষ হয়তো মাঠে ধূমপান করছেন, তবে সেখানে অনেক হাওয়া চলাচল রয়েছে । এই জন্য কিছুটা হলেও সেটা ডাইলুশন হচ্ছে । অথচ, বাড়িতে যে মহিলা উনুনে রান্না করছেন, সেখানে তেমন খোলামেলা পরিবেশ নাও থাকতে পারে । তার ক্ষেত্রে ধোঁয়া অনেক বেশি ক্ষতি করছে । এর সঙ্গে, ওই ব্যক্তি বাড়িতেও ওই মহিলার সামনে যদি ধূমপান করেন, তাহলে ওই ধোঁয়া ওই মহিলার শরীরে প্রবেশ করছে । এমন কারণেও গ্রামের মহিলাদের অনেকের মধ্যে COPD রয়েছে । COPD বেড়ে চলেছে । কেউ হয়তো এমন কোনও কারখানায় কাজ করছেন, যেখানে অনেক ধোঁয়া বা ধুলো রয়েছে । যে ট্রাফিক পুলিশ অনেক ধুলো-ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করছেন । এসব ক্ষেত্রে, ধূমপান না করলেও COPD হতে পারে । এমন অনেক দমকলকর্মী রয়েছেন, যাঁরা হয়তো ধূমপান করেন না । কিন্তু আগুন নেভানোর কাজ করার জন্য, তাঁদের অনেকের COPD হতে পারে । কারণ, আগুনের ধোয়ার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ থাকে । এগুলি ধূমপানের থেকেও বেশি ক্ষতিকর ।
COPD-র চিকিৎসা কী রয়েছে?
চিকিৎসার ক্ষেত্রে, প্রথমেই প্রতিরোধের বিষয়টি বলা যায় । ধোঁয়া যাতে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, সেটা দেখতে হবে । অর্থাৎ, কারও ক্ষেত্রে COPD না হওয়া যেমন বাঞ্ছনীয় তেমনই, COPD হলে সেটা যেন বাড়তে না দেওয়া হয় । COPD শুরু হওয়া মানে পাহাড়ের উপর থেকে একটি পাথর ঠেলে দেওয়ার মতো । ওই পাথরটিকে আর না ঠেললেও, নিচের দিকে নামতে থাকবে । তেমনই, COPD হওয়া মানে, শ্বাসনালীর সংকুচিত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি চলতেই থাকবে । যদি, COPD হওয়ার পরে, ধূমপান অথবা অন্য কারণে ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ নাও করে, তাও বাড়তে থাকে । আর যদি ধূমপান বা অন্য কোনও কারণে ধোঁয়া শরীরে প্রবেশ করতে থাকে, তা হলে COPD-র সমস্যা আরও বেশি বাড়তে থাকে ।
চিকিৎসার একটি বিষয় হল প্রতিরোধ । অন্য একটি বিষয় হল, ফুসফুসে হাওয়া প্রবেশ এবং ফুসফুস থেকে হাওয়া বের হওয়ার ব্যবস্থাকে ভালো করা অর্থাৎ, শ্বাসনালীকে চওড়া করা । এর জন্য ওষুধ রয়েছে । বেশ কিছু খাওয়ার ওষুধ রয়েছে । তবে এই ওষুধ সরাসরি পেটে যায় । এর পরে রক্তবাহিত হয়ে গোটা শরীরে পৌঁছয় । এক্ষেত্রে ইনহেলার ব্যবহার করা হলে, ওষুধ সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছচ্ছে । সেখানে কাজ করছে, অন্যান্য অর্গানে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে না । ইনহেলারের ক্ষেত্রে ওষুধের পরিমাণও অনেক কম লাগে । কারণ মুখে খাওয়া ওষুধের অনেকটা পেটে গিয়ে হজম হয়ে যায় । ভ্যাকসিন রয়েছে । COPD আক্রান্তদের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ বারে বারে হয় । ভাইরাল নিউমোনিয়া হয়, ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া হয় । এগুলি যাতে না হয় তার জন্য ভ্যাকসিন রয়েছে । নিয়মিত ভ্যাকসিন নেওয়া হলে COPD-র জেরে যে সংক্রমনের বাড়াবাড়ি হয়, বিশেষ করে বর্ষাকাল এবং শীত আসা-যাওয়ার সময় দেখা দেয়, সেগুলি অনেক কম হবে । COPD-র বাড়াবাড়ি কম হলে শ্বাসনালীর সরু হওয়ার ব্যাপারটাও কম হবে ।
যে কোনও বয়সের মানুষই কি COPD-তে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন?