প্রাক্তন অধ্যাপক শুভেন্দু মজুমদার কলকাতা, 15 অগস্ট: স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় । ব্রিটিশ রাজে জর্জরিত ভারতবাসীর প্রাণের কথা ছিল এটাই । সেই হীনতা থেকে মুক্তি পেতেই নিরন্তর আন্দোলন । ফলস্বরূপ 1947 সালে 15 অগস্ট আসে বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা । তবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই ইতিহাস সেভাবে লিপিবদ্ধ নেই । বহু তথ্যের নথি মেলে না । বহু প্রশ্নের উত্তর আজও অধরা ।
বলা হয়, স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালির অবদান অনস্বীকার্য । বাংলা থেকেই ডাক উঠেছিল দেশ স্বাধীন করার । কিন্তু ঠিক কতজন বাঙালি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্তত একদিনের জন্য জেল খেটেছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি । অথচ তথ্য যে নেই তা নয় । কোনও অজ্ঞাত কারণে তা নিয়ে কেউ আগ্রহ দেখাননি । স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করছেন প্রাক্তন অধ্যাপক শুভেন্দু মজুমদার । দীর্ঘ গবেষণার পরে যে তথ্য তাঁর কাছে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, দশ হাজার বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য জেল খেটেছিলেন । সেই জেল খাটার মেয়াদ সর্বোচ্চ 30 বছর । সর্বনিম্ন একদিন । ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী 30 বছর জেল খেটেছিলেন ।
এর পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন সামনে আসে । কতজন বাঙালি দেশের স্বাধীনতার জন্য ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিয়েছিলেন । এ ক্ষেত্রে যে সমস্ত আন্দোলনকারীর বিচার ভারতীয় দণ্ডবিধি মেনে হয়েছিল কেবল সেটাই ধরা হয়েছে । সেই কারণে মহারাজা নন্দকুমারে ফাঁসি ধরা হয়নি । কিংবা নীল চাষ না করতে চাওয়ার কারণে ইংরেজদের গরিব কৃষককে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেওয়ার ঘটনাও বাদ দেওয়া হয়েছে । একইভাবে সামাজিক অপকর্ম করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার ঘটনাও বাদ পড়েছে ।
আরও পড়ুন:পার্লামেন্ট হাউসে ভগৎ সিং-বটুকেশ্বর দত্তদের বোমা বর্ষণ ও খণ্ডঘোষের সেই পাতাল ঘর
প্রাক্তন অধ্যাপক শুভেন্দু মজুমদারের গবেষণা বলছে, মোট 41 জন বাঙালি বিপ্লবীর স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণে ফাঁসি হয়েছিল । 1908 সালের 11 অগস্ট ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয় । তারপর থেকে 1944 সালে শেষ বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীর ফাঁসির ঘটনা ঘটে, ফাঁসি হয় সতীন্দ্রলাল মজুমদারের । নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আইএনএ-র সেনানী সতীন্দ্রলাল মজুমদারকে দিল্লির লালকেল্লায় কোর্ট মার্শাল করা হয়েছিল ।
41জন বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীর ফাঁসির মধ্যে দশটি হয়েছিল কলকাতায় । শুভেন্দু মজুমদারের গবেষণা বলছে, আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ছয়জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর ফাঁসি হয় । চারজনের ফাঁসি হয়েছিল প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে । দমদম সেন্ট্রাল জেলে কোনও ফাঁসির ঘটনার উল্লেখ সরকারি নথিতে নেই । 1909 সালের 19 মার্চ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে প্রথম কোনও বাঙালির ফাঁসি হয় । মৃত্যুবরণ করেন চারুচন্দ্র বসু ।
1926 সালে অনন্তহরি মিত্র, প্রমোদরঞ্জন চৌধুরীর ফাঁসি হয় । এরপর দীনেশ গুপ্তর ফাঁসি হয় । রামকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং দীনেশ মজুমদারেরও ফাঁসি হয়েছিল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে । প্রেসিডেন্সি জেলে 1908 সালের 10 নভেম্বর ফাঁসি হয়েছিল কানাইলাল দত্তের । 11 দিন পরে অর্থাৎ 1908 সালের 21 নভেম্বর ফাঁসি হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর । 1910 সালের 21 ফেব্রুয়ারি ফাঁসি হয় বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তের । 1924 সালের পয়লা মার্চ ফাঁসি হয়েছিল গোপীনাথ সাহার ।
আলিপুর সেন্ট্রাল জেল এখন সংগ্রহশালা । বিপ্লবীদের বীরগাথা ওখানে রয়েছে । কিন্তু গবেষকরা বলছেন, সেই উদ্যোগ মহৎ হলেও সঠিকভাবে সংরক্ষণ হয়নি । তথ্য বিকৃতি রয়েছে । উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, ঋষি অরবিন্দ ঘোষ সেন্ট্রাল জেলে ছিলেন না । তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে । তিন মাস আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে কারারুদ্ধ ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু । তাঁর সঙ্গে নাকি দেখা করতে আসতেন ইন্দিরা গান্ধি । কিন্তু কবে তিনি দেখা করতে এসেছিলেন সেখানে উল্লেখ নেই ।
আরও পড়ুন:বাড়িতেই স্বাধীনতা দিবস পালন, পাতে রাখুন তেরঙা রেসিপি
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়, জওহরলাল নেহেরু আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ছিলেন বলা হয়েছে । তবে বাঘাযতীন একবছর এই সেন্ট্রাল জেলে ছিলেন, তার উল্লেখ নেই । এমনকী লেখা নথিতেও নেই । একইভাবে কাজী নজরুল ইসলামের আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকার উল্লেখ নেই । উল্লেখ নেই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা । যিনি জেলবন্দি বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে 39 বার দেখা করেছিলেন নাম পরিবর্তন করে । বেথুন কলেজের ছাত্রী অমিতা দাস নাম নিয়ে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন দলের নির্দেশে ।
সব মিলিয়ে বাঙালির আত্মত্যাগের ইতিহাস রয়েছে মহাফেজ খানায় ৷ কিন্তু সঠিক সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে তা আগামীর সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ করেছে গবেষক এবং বিপ্লবীদের পরিবার ।