কলকাতা, 30 জুলাই : দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কোরোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৷ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও ৷ কোরোনা মোকাবিলায় চলছে বিভিন্ন গবেষণা ৷ কয়েকটি ভ্যাকসিনের হিউম্যান ট্রায়াল শুরু হয়েছে ৷ কয়েকটি ওষুধ ব্যবহারের অনুমতি মিলেছে আবার কোনও ওষুধ ব্যবহার করতে না বলা হয়েছে ৷ কোরোনা চিকিৎসার জন্য সত্যিই কি কোনও ওষুধ নেই ? কীভাবে হচ্ছে কোরোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা? চিকিৎসকরা বলছেন, তিন-চার মাস আগেও কোরোনা মোকাবিলায় নিজেদের যতটা অসহায় মনে হত এখন আর ততটা মনে হয় না । কোরোনার বিরুদ্ধে তাঁদের হাতে এখন বেশ কিছু অস্ত্র রয়েছে । তবে, এখনও ট্রায়াল অ্যান্ড এরর ফেজ়ের মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হচ্ছে । ওষুধের প্রয়োগ করে শিখতে হচ্ছে । চিকিৎসা করতে করতে চিকিৎসার পদ্ধতি পরিমার্জন, পরিবর্ধন করা হচ্ছে ।
প্রাথমিকভাবে কোরোনা আমাদের শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ঘটায় । হাসপাতালে এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্লিনিকালি রোগীর সিভিয়ারিটি অনুযায়ী তিন ভাগে ভাগ করা হয় বলে জানিয়েছেন ইনফেকশাস ডিজ়িজ়েস অ্যান্ড বেলেঘাটা জেনেরাল (ID&BG) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসক তপন বিশ্বাস ।
তিনি বলেন, "যাঁদের জ্বর, সর্দি, কাশি রয়েছে, তাঁদের সিম্পটোম্যাটিক চিকিৎসা করা হয় । জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল দেওয়া হয় । কাশির জন্য দেওয়া হয় সিরাপ । এই ক্ষেত্রে যাঁদের কোমরবিডিটি রয়েছে এবং 50 বছরের বেশি বয়স তাঁদের অ্যান্টিবায়োটিক এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন দিয়ে থাকি । এর সঙ্গে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স উইথ সি অথবা যদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায় তা হলে সেটা দেওয়া হয় । প্রতিটি রোগীকে বিটাডিন দিয়ে গারগল করতে বলা হয় ।"
এছাড়া মাইল্ড সিম্পটোম্যাটিকের সঙ্গে যাঁদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে অর্থাৎ, সর্দি, কাশি, জ্বর, অল্প অল্প শ্বাসকষ্ট, যাঁদের ক্ষেত্রে অল্প অক্সিজেন দেওয়ার দরকার হচ্ছে তাঁদের মডারেট গ্রুপ বলা হয় । তিনি বলেন, "এই রোগীদের ক্ষেত্রে মাইল্ড সিম্পটোম্যাটিকের জন্য যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে আরও দু'টি ওষুধ আমরা যোগ করি । প্রথমত, এই ক্ষেত্রে আমরা স্টেরয়েড ব্যবহার করি । স্টেরয়েডের মধ্যে সাধারণত ডেক্সামেথাজ়োন দেওয়া হয় । এর সঙ্গে লো মলিকিউলার ওয়েট হেপারিন বা হেপারিন দেওয়া হয় । কারণ ইউরোপের একটি গবেষণায় অটোপসি করে দেখা গেছে যে, অনেক রোগীর ফুসফুসের মধ্যে রক্ত জমে গেছে । যাতে রক্ত জমাট না বাঁধে, রক্ত যাতে তরল থাকে তার জন্য এই লো মলিকিউলার ওয়েট হেপারিন বা হেপারিন, এই দুটি ওষুধের মধ্যে একটি দেওয়া হয় । ডেক্সামেথাজ়োনের উপর গবেষণায় দেখা গেছে যে, এতে রোগের সিভিয়ারিটি অনেকটা কমিয়ে দেয় । যেহেতু রোগীকে স্টেরয়েড দেওয়া হচ্ছে তাই তাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে । এ ক্ষেত্রে সাধারণত আমরা অ্যাজিথ্রোমাইসিন দিয়ে থাকি । এর সঙ্গে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয় । অক্সিজেনেরও বিভিন্ন লেভেল আছে । যেমন, যদি কেনিউলা দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয় তা হলে সাধারণত চার-পাঁচ লিটার পর্যন্ত দেওয়া যায় । কারও ক্ষেত্রে চার-পাঁচ লিটারের উপর অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয় ।
আর এক ধরনের রোগীদের সিভিয়ার গ্রুপ হিসেবে ধরা হয় । তপনবাবু বলেন, "যে রোগীর ক্ষেত্রে 15 লিটার অক্সিজেন দিয়ে অক্সিজেনের স্যাচুরেশন বজায় রাখা যাচ্ছে না, অক্সিজেন স্যাচুরেশন 94-এর উপর থাকছে না, হাইপোক্সিয়ার জন্য তাঁদের ব্রেন ঠিকমতো কাজ করছে না । রক্তচাপ ওঠানামা করছে, বেড়ে যাচ্ছে বা কমে যাচ্ছে, তখন বুঝতে হবে এই রোগীর ক্ষেত্রে এভাবে অক্সিজেন দিয়ে আর লাভ নেই । তখন এই রোগীকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রাখতে হবে । ভেন্টিলেশনে আমরা সাধারণত 100 শতাংশ অক্সিজেন দিতে পারি এবং 100 লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেওয়া যায় । কতটা পরিমাণে, কতটা ফ্লো-তে অক্সিজেন দেওয়া হবে তা ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে মনিটর করা হবে । সাধারণত দেখা গেছে যাঁদের ক্ষেত্রে কোরোনা গুরুতর এবং বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হতে শুরু করেছে তাঁদেরকেই সাধারণত ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয় । এই ভেন্টিলেশন বাদে আরও কিছু অ্যাডজাঙ্কটিভ থেরাপি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চালু হয়েছে । এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে যেটা চালু হয়েছে তা হল প্লাজ়মা থেরাপি । তবে এর ফলাফল এখনই বলা যাবে না । কারণ নতুন ধরনের চিকিৎসা চালু হলে সেক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হয় ।
কীভাবে বোঝা হয় অক্সিজেনের প্রয়োজন বাড়ছে কি না?
তপন বিশ্বাস বলেন, "এর জন্য অক্সিজেনের প্রেসক্রিপশন করা হয় । এই প্রেসক্রিপশনের জন্য পালস অক্সিমিটার দিয়ে রোগীর শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ দেখে নেওয়া হয় । সাধারণত 94-এর উপরে অক্সিজেন থাকে । রোগীকে এমন লেভেলে অক্সিজেন দেওয়া হবে যাতে সব সময় 94-এর বেশি থাকে । এর জন্য অক্সিজেন দুই লিটার লাগুক বা 10 লিটার কিংবা 15 লিটার, সেটা দেওয়া হবে । অক্সিজেন দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ডিভাইস রয়েছে । প্রাথমিকভাবে আমরা সাধারণত ন্যাজ়াল কেনিউলা দিয়ে অক্সিজেন দিই । এতে যদি অক্সিজেন স্যাচুরেশন 94-এর উপর না ওঠে তখন অন্য এক ধরনের ডিভাইসের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয় । এই ডিভাইসকে বলে ফেস মাস্ক । এর মাধ্যমে আরও একটু বেশি অক্সিজেন দেওয়া যায় । এভাবে অক্সিজেন দেওয়ার পরও যদি 94-এর উপর না থাকে তখন NRPM অক্সিজেন ডিভাইস দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয় । এতেও যদি কাজ না হয় তাহলে হাই ফ্লো ন্যাজ়াল কেনিউলা ডিভাইসের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয় । এই ধরনের অক্সিজেন ডিভাইস রাখার জন্য স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে বিভিন্ন হাসপাতালকে অনুরোধ করা হচ্ছে । কারণ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে হাই ফ্লো ন্যাজ়াল কেনিউলা ডিভাইসের মাধ্যমে যদি অক্সিজেন দেওয়া হয় তাহলে অনেক রোগীর ক্ষেত্রে ভেন্টিলেটরের সাপোর্ট এড়ানো যাবে ।"
তিনি বলেন, "হাসপাতালে কোরোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য আরও কিছু ওষুধ রয়েছে । যেমন, রেমডেসিভির । অ্যামেরিকাতে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, রেমডেসিভির যদি ব্যবহার করা হয় তাহলে মৃত্যুর হার অনেকটা কম হবে । তবে 100 শতাংশ সুস্থ হওয়ার মতো কোনও ওষুধ এখনও পর্যন্ত আমাদের হাতে আসেনি । এখনও পর্যন্ত যা আছে, সে সব দিয়ে বিভিন্ন দেশে চেষ্টা হচ্ছে যাতে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় । কিন্তু এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট কার্যকরী ওষুধ পাওয়া যায়নি ।"