1931 সাল। জুলাই মাস। আলিপুর জেলে দীনেশ গুপ্তর ফাঁসি হয়ে গিয়েছে। "Blood Calls for Blood"- ফুটছে গোটা বাংলা। ঢাকা থেকে মেদিনীপুর, বিলি হচ্ছে ইশতেহার। ইংরেজ শাসকের অত্যাচার সহ্য নয়- ফুটছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও। স্পর্ধা কমেনি শাসকের। দমন নীতি নিয়ে একের পর এক অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেটকে বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করছিল তারা। তারুণ্যের তেজ আর দেশপ্রেমের আগুনে সে সব অত্যাচারী শাসককে ঝলসে দিতে কোমর বাঁধছিলেন একের পর এক স্বাধীনতা সংগ্রামী। প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য তাঁদেরই একজন।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বুদ্ধিমান, শান্ত। সরল মুখে তীক্ষ্ণ ছিল চোখদুটি । মেধাবী ছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন প্রথম বিভাগে । ছাত্রাবস্থাতেই প্রতিবাদের আগুন কীভাবে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল স্নেহের 'কচি'র (প্রদ্যোৎ কুমার ভট্টাচার্যের ডাকনাম) মধ্যে, বুঝতে পারেননি বাবা ভবতারণ। মেদিনীপুরে তখন বেশ সক্রিয় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। সংক্ষেপে BV। সংগঠনের সক্রিয় কার্যকলাপে ভীতসন্ত্রস্ত ইংরেজ শাসক। ছাত্র প্রদ্যোতের বুকে স্বাধীনতার আগুন জ্বালাতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল এই সংগঠন। বয়স তখন 16 কী 17। বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সংস্পর্শে এসেছিলেন প্রদ্যোৎ। অবশ্য-পালনীয় 'মন্ত্রগুপ্তি' রক্ষা। আর ধরা পড়লে অত্যাচার সহ্য করার দৃঢ়তা । এই দুই যাচাই করে তাঁকে সংগঠনের সদস্য করে নিয়েছিলেন দীনেশ গুপ্ত। সশস্ত্র বিপ্লবের পথচলা শুরু তখন থেকে।
এরপর ধীরে ধীরে সত্য গুপ্ত, হেমচন্দ্র ঘোষ, জ্যোতিষ জোয়ারদারদের মতো অগ্রণী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংস্পর্শে আসা। এবং নিজেকে BV গ্রুপের অন্যতম সদস্য বানিয়ে তোলা। সময় নেননি বেশিদিন।
1931 সাল। মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট তখন জেমস প্যাডি। তাঁর সদম্ভ ঘোষণা ছিল - এমন শিক্ষা দেবেন, মেদিনীপুর যা কোনও দিন ভুলবে না। প্যাডিকে চরম শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল BV।
মার্চ মাস। গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় স্থানীয় স্টেশন চত্বরের নির্জন মাঠে অন্ধকারে গা ঘেঁষে আলাপচারিতায় পাঁচ বিপ্লবী। প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, প্রফুল্ল দত্ত, বিমল দাশগুপ্ত, জ্যোতিজীবন ঘোষ, ফণীভূষণ কুণ্ডু। ওই মাঠেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল প্যাডিকে পৃথিবী থেকে সরানোর মাস্টারপ্ল্যান।
7 এপ্রিল সন্ধ্যা। জেলা স্কুলের শিক্ষা প্রদর্শনীতে হাজির ছিলেন প্যাডি। বিমল দাশগুপ্ত, জ্যোতিজীবন ঘোষের আকস্মিক আক্রমণ। গুলিতে ঝাঁঝরা অত্যাচারী শাসক প্যাডি। নক্ষত্রগতিতে এলাকা ছেড়েছিলেন দুই বিপ্লবী।
ইংরেজ তৎপরতা বাড়ে মেদিনীপুরে। মোতায়েন হন আরেক অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট ডগলাস। জেলায় চালু হয় সান্ধ্য আইন। সন্ধের পরে লণ্ঠন ছাড়া বাইরে বেরোনো নিষিদ্ধ করা হয়। সাদা, নীল ও লাল। তিন রঙের কার্ড চালু হয় জেলায়। সাদা কার্ড রাজভক্তদের জন্য। স্বদেশীদের জন্য নীল কার্ড। লাল কার্ড বিপজ্জনক ব্যক্তির জন্য। স্পেশাল কনস্টেবল আইন চালু করা হয়। এই আইন বলে বিপ্লবীদের নির্দেশ দেওয়া হয় সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটি দিনে থানায় হাজিরার। দিনের পর দিন বাড়তে থাকে অত্যাচার। কোনও শ্বেতাঙ্গ শাসককে মেদিনীপুরে টিকতে দেওয়া হবে না - এই বিপ্লবী-পণের পরের টার্গেট হয়ে যান ডগলাস।
সেপ্টেম্বর। হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্পে (এখনকার খড়গপুর IIT ক্যাম্পাস) বন্দীদের উপর অত্যাচার আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। 16 সেপ্টেম্বর নিরস্ত্র বন্দীদের উপর গুলি চালায় পুলিশ। শহিদ হন বিপ্লবী সন্তোষকুমার মিত্র, বিপ্লবী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। আহত হন আরও অনেকে।
শহিদদের নিয়ে শবযাত্রা করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সবরকম নিন্দার মাত্রা ছাড়িয়েছে এই ঘটনা- তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কলকাতা মনুমেন্টের পাদদেশে সভা করেছিলেন 26 সেপ্টেম্বর। আর BV-র খতম তালিকায় একেবারে শীর্ষে তোলা হয়েছিল ডগলাসের নাম। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অ্যাকশন স্কোয়াডের দুই সদস্য প্রদ্যোৎ কুমার ভট্টাচার্য ও প্রভাংশুশেখর পালকে।
আরও পড়ুন... একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি...
জীবন-সংশয় আশঙ্কায় নিরাপত্তা দ্বিগুণ হয় ডগলাসের। কিন্তু তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা ছিল শতগুণ।
চেষ্টা চলছিল। সুযোগ আসছিল না। অবশেষে এল মাহেন্দ্রক্ষণ। 30 এপ্রিলের দুপুর। জেলা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মিটিংয়ে হাজির ছিলেন ডগলাস। ছিলেন সভাপতির চেয়ারে। বিকেল নাগাদ জোর করে মিটিং রুমে ঢুকে পড়েন প্রদ্যোৎকুমার ভট্টাচার্য, প্রভাংশুশেখর পাল। না, রক্ষীরা কোনওভাবেই ধরতে পারেনি তাঁদের। অতি-ক্ষিপ্রতায় ডগলাসের চেয়ারের পিছনে চলে যান দু'জনে।
তখন বিকেল। ঘড়িতে 5টা 45। ডগলাসকে লক্ষ্য করে 7টা গুলি চলে। তারপর দ্রুত পালানোর চেষ্টা করেন দুই বিপ্লবী। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পালাতে থাকেন প্রভাংশুশেখর পাল। কিন্তু প্রদ্যোৎ পারেননি। বিপত্তি বাধায় তাঁর রিভলভার। তিনি ছুটতে শুরু করেন। পিছনে পুলিশ। ঘুরে বার কয়েক ফায়ার করার চেষ্টা করেন প্রদ্যোৎ। কিন্তু গুলি বেরোয়নি। কাছের এক পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। পিছনে তাড়া করে ঘরে ঢোকে পুলিশ। ঘর থেকে কোনওমতে বেরিয়ে ফের পালানোর চেষ্টা করেন বিপ্লবী। স্থানীয় অমর লজের কাছে রাস্তার উপর ছিটকে পড়েন। ঘিরে ফেলে পুলিশ। প্রদ্যোতের পকেট থেকে বেরিয়ে আসে দুটি ছোট চিরকুট। যার একটিতে লেখা ছিল - “This is a mild protest against the Hijli Massacre. May India be awakened by these deaths!”