পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

নিভল ভারতীয় ফুটবলের প্রদীপ

By

Published : Mar 20, 2020, 2:15 PM IST

Updated : Mar 20, 2020, 4:15 PM IST

চলে গেলেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ বয়স হয়েছিল 83 ৷ বার্ধক্য়জনিত অসুস্থতায় বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি ছিলেন তিনি ৷ কয়েকদিন আগেই কোমায় চলে যান ৷ আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি ৷

FORMER footballer pradip banerjee died in kolkata
নিভল ভারতীয় ফুটবলের প্রদীপ

কলকাতা, 20 মার্চ : চলে গেলেন প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল 83 বছর । কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে বেশ কয়েকদিন অসুস্থ অবস্থায় ভরতি থাকার পরে আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অশীতিপর ফুটবল কিংবদন্তি ।

স্ত্রী আরতি বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক বছর আগেই প্রয়াত হয়েছেন । দুই মেয়ে পলা এবং পিক্সিই ছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র অবলম্বন । গত একমাস ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় কাবু ছিলেন তিনি । ঠান্ডা লাগার কারণে বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন । মাঝে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন । 28 ফেব্রুয়ারি তাঁকে পুনরায় ভরতি করতে হয় হাসপাতালে, তখন থেকেই ICU-তে ছিলেন । কয়েকদিন আগেই কোমায় চলে যান তিনি । আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তাঁর প্রয়াণে ভারতীয় ফুটবল হারাল এক বর্ণময় চরিত্রকে । ফুটবলার কোচ হিসেবে ক্লাব এবং জাতীয় দলের হয়ে সফল মানুষটির মৃত্যুতে শোকের ছায়া শুধু ফুটবল নয়, দেশের ক্রীড়াজগতেও । ভারতীয় ফুটবলের অনেক তারার মাঝে ধ্রুবতারা হিসাবে আজীবন উজ্বল হয়ে থাকবেন প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ।

তিনি নিজের পোশাকি নামের চেয়ে ‘পি.কে’ হিসেবেই পরিচিত এবং সমাদৃত । 1936 সালের 23 জুন জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় । বাবার চাকরি সূত্রে বিহারের টাটানগরে কেটেছে ছোটোবেলা । সেখনে আর ডি টাটা হাইস্কুলের হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন । মাত্র 15 বছর বয়সে বিহারের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলতে এসে প্রথম নজরে পড়েন । 1954 সালে এরিয়ানের জার্সিতে কলকাতা ময়দানে প্রথম খেলতে নামেন । প্রথম বছর থেকেই নজর কাড়া ফুটবল স্কিলে বুঝিয়ে দেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া । কলকাতার তিন প্রধানের হয়ে না খেলেও ভারতীয় ফুটবলের নক্ষত্র হয়ে ওঠেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় । দেশের জার্সিতে কেবল 84টি ম্যাচই খেলেননি, ভারতীয় ফুটবলের কোহিনুর হয়ে আলো ছড়িয়েছেন তিনি । তাঁর ঝুলিতে রয়েছে 65টি গোল । ক্লাব ফুটবলে তিন প্রধানের বাইরে ইস্টার্ন রেল কলকাতা লিগ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন । সেই দলের মূলস্তম্ভ ছিলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ রাইট উইং এবং স্ট্রাইকার হিসাবে খেলতেন । গতি ও জোরালো শটের জন্যে বিখ্যাত ছিলেন তিনি । 1955 সালে দেশের হয়ে ঢাকার মাটিতে কোয়াড্রাঙ্গুলার প্রতিযোগিতায় নজরকাড়া ফুটবল উপহার দেন তিনি । এরপর 1958, 1962, 1966 সালের এশিয়ান গেমসে খেলেছেন পি কে । 62 সালে জাকার্তা এশিয়ান গেমসের সোনা জয়ী ভারতীয় ফুটবল দলের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি । সেইসময়ে পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী ও তুলসী দাস বলরাম ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের তিনমূর্তি । তাদের দাপটে কাঁপত অন্য দেশের খেলোয়াড়রা ৷ 1956 সালের হেলিসিঙ্কি অলিম্পিকে চতুর্থ হয়েছিল ভারত । সেই দলের সদস্য ছিলেন পি কে ।

1960 সালের রোম অলিম্পিকে দেশের নেতৃত্বের ভার ছিল প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরই । ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বলরামের পাস থেকে শুরু করে তাঁর করা গোল- আজও পুরানো ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে । 1967 সালে কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে তাঁর জোরালো শটে গোলের হদিস পাননি সেদিনের কিংবদন্তি গোলরক্ষক পিটার থঙ্গরাজ । ওই বছরই ছিল ফুটবলার হিসাবে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ বছর । এরপর ফুটবলার থেকে প্রশিক্ষক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রূপান্তর হয় । কলকাতার মাঠে বাটা স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিষেক হয় । 1972 সালে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হয়ে আসার পরে তাঁর কোচিং জীবনের সেরা পর্বের শুরু । ম্যান ম্যানেজমেন্ট, গেম রিডিং- সব জায়গাতেই সেই সময় নতুন ভাবনার আমদানি করেছিলেন তিনি । 1972 থেকে 1975 সাল পর্যন্ত ইস্টবেঙ্গলের দাপুটে ফুটবলের কারিগর ছিলেন । 1976 সালে মোহনবাগানে গিয়েও তিনিই ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের ‘‘টপ বস’’ ।

1972 সালে ইস্টবেঙ্গলকে যেমন ত্রিমুকুট এনে দিয়েছিলেন, 1977 সালেও একইভাবে মোহনবাগানকে ত্রিমুকুট দিয়েছিলেন । 1980 সালে ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসেবে ফের সেরা হিসাবে নিজেকে প্রমাণিত করেন তিনি । সেই বছর ভাঙাচোরা ইস্টবেঙ্গল দলকে সারাবছর অপরাজিত রেখেছিলেন মজিদ বিসকার, জামশেদ নাসিরি এবং মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের দুরন্ত ফুটবলের উপর ভর দিয়ে । 1985 সালে ইস্টবেঙ্গলকে এশিয়ান মানদণ্ডের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি । নয়ের দশকে প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রশিক্ষণের দায়িত্বও সামলেছিলেন পি কে ।

প্রশিক্ষক অমল দত্তের সঙ্গে তার ফুটবল বুদ্ধির টক্কর ভারতীয় ক্লাব ফুটবলের বিশেষ চর্চিত বিষয় । অমল দত্তের ডায়মন্ড সিস্টেমকে টেক্কা দেওয়ার জন্য সেরা লোক ছিলেন প্রশিক্ষক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় । 1972 সালে মিউনিখ অলিম্পিকগামী ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় । 1982 এবং 1986 সালের এশিয়ান গেমসেও ভারতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি । ফুটবলের বাইরেও ছিল তার প্রতিভা ৷ অসম্ভব ভালো বাগ্মী মানুষটি ধারাভাষ্যকার হিসেবেও সফল ও পরিচিত হয়েছিলেন । ফুটবলের কলম লিখিয়ে হিসেবেও তিনি সমাদৃত । চলচ্চিত্র অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন তিনি ৷ জমাটি আড্ডায় মধ্যমণি হিসাবেই উপস্থিত থাকতেন । বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে অনর্গল বলে যাওয়ার বিরল ক্ষমতা ছিল পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের ।

তিনি অবসর সময়ে সচিন কর্তার গান গাইতে এবং শুনতে ভালোবাসতেন । আড্ডায় অনুরোধে কয়েক কলিও গাইতেন তিনি । কয়েকমাস আগে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় তাঁর বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন । প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একা নন, তাঁর ভাই প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ও ফুটবলার ছিলেন । কিন্তু প্রশিক্ষক প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল নিরপেক্ষতা । 1961 সালে তিনিই প্রথম ফুটবলার হিসাবে অর্জুন পুরস্কার পান । 1990 সালে পদ্মশ্রী সম্মানেও ভূষিত হন । 2004 সালে FIFA প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভারতের ‘শতাব্দী সেরা ফুটবল ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে সম্মানিত করে । বুদ্ধির পাশাপাশি ফুটবলারদের থেকে নিজেদের সেরাটা বের করার জন্যে তাঁর ভোকাল টনিক এখনও চর্চিত । ‘‘জার্সি মা ’’,‘‘মায়ের সম্মান রক্ষায় নিজেকে উজাড় করে দাও’’ - তাঁর এমন কথায় ফুটবলাররা উদ্বুদ্ধ হয়ে যেতেন । তার বিখ্যাত উক্তি ছিল ‘‘ডাঁটা চচ্চড়ির মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করা যায় না’’, তা আজও অমর । তবে ডাঁটা চচ্চড়ির মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করতে হলে যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়, তা গ্রহণ করেছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ সদা বর্ণময়, বাগ্মী, ফুটবলপটু প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ইহলোকের মায়া কাটিয়ে গমন করলেন পরলোকে । নিভে গেল ভারতীয় ফুটবলের উজ্বল প্রদীপ ।

Last Updated : Mar 20, 2020, 4:15 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details