কলকাতা, ২০ এপ্রিল : ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া এবং ম্যালেরিয়া এখন এদেশে এনডেমিক অর্থাৎ, প্রতি বছর নিয়ম মেনে এই তিনটি রোগের সংক্রমণ ঘটে । এই তিনটি রোগের জীবাণু বহন করে মশা । ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য ওষুধ রয়েছে । ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে কোনও সুনির্দিষ্ট ওষুধ এখনও পর্যন্ত নেই । এদিকে, একই সঙ্গে এই তিনটি রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে । সেই ক্ষেত্রে মৃত্যুর আশঙ্কাও থেকে যায় । যদিও, একইসঙ্গে এই তিনটি রোগের সংক্রমণের ঘটনা খুবই বিরল । কিন্তু, কীভাবে ঘটে এমন সংক্রমণ? এক্ষেত্রে চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায়ই বা কী? বিষয়গুলি নিয়ে জানিয়েছেন কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অমিয়কুমার হাটি ।
অমিয়কুমারবাবু বলেন, "কলকাতায ও রাজ্যে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সময় ধরতে গেলে একই । যদিও ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ সারা বছর ধরে ঘটে । তবুও বেশিরভাগ সংক্রমণ ঘটে জুলাই-অগাস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত । এই সময় ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণও ঘটে ।
ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ একসঙ্গে ঘটে কি না, এটা দেখার দরকার ছিল । এই জন্য দু'টি সমীক্ষাও আমরা করেছিলাম । একটি সমীক্ষা হয়েছিল ২০০৫-২০১০-এর সময়কালে । এই সমীক্ষায় দেখা গেছিল, ডেঙ্গির সংক্রমণ ঘটেছিল ৬০৫টি । এর মধ্যে ৪৬টি ক্ষেত্রে একই সঙ্গে ছিল ডেঙ্গি এবং ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ । এই ৪৬টির মধ্যে ভাইভ্যাক্স ম্যালেরিয়ার ২৮টি এবং ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার ১৮টি সংক্রমণ দেখা গেছিল ।
অন্য একটি সমীক্ষা হয়েছিল ২০১১-র জুলাই থেকে ২০১২-র আগস্ট মাস পর্যন্ত । এই সমীক্ষায় ২৫২টি রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে দেখার চেষ্টা হয়েছিল ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া এবং ম্যালেরিয়ার সংক্রমণের বিষয়টি । এই সমীক্ষায় দেখা গেছিল, ১১ বছরের এক রোগীর একই সঙ্গে ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ঘটেছে । এই সমীক্ষায় খুবই বিরল একটি ঘটনা দেখা গেছিল । ৪০ বছরের এক রোগীর ক্ষেত্রে একই সঙ্গে ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ দেখা গেছিল । একই সঙ্গে এই তিনটি রোগের ঘটনা বিরলতম ।"
তিনি আরও বলেন, "ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া এবং ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ এখন আমাদের দেশে প্রতি বছর নিয়ম মেনে হয় । ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ছড়ায় এডিস মশা । ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ছড়ায় অ্যানোফিলিস মশা । এই তিনটি রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সময়ও একই, অগাস্ট থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে । ডেঙ্গির সংক্রমণ চলছে, এর সঙ্গে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণও চলছে, এর সঙ্গে চিকুনগুনিয়াও হচ্ছে ।
একই সঙ্গে এই তিনটি রোগের জীবাণুর সংক্রমণ ঘটছে, এক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এমন হয়েছে যে কোনও এক মানুষকে ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী মশা কামড়েছে । এর পাশাপাশি তাঁকে এডিস মশা কামড়েছে, যে মশা হয়ত ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার জীবাণু একই সঙ্গে বহন করছিল । অথবা, ডেঙ্গির জীবাণু বহনকারী একটি মশা এবং চিকুনগুনিয়ার জীবাণু বহনকারী অন্য একটি মশাও কামড়ে থাকতে পারে ।"
উপসর্গ কী? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ অনেকটা একই ধরনের । ম্যালেরিয়ার উপসর্গ একটু অন্য ধরনের । ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে । সাধারণত একদিন অন্তর জ্বর আসে । মাথা ব্যথা এবং বমি হয় । ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে গা-হাত-পায়ে ব্যথা হয় । এর সঙ্গে মাথা, চোখের মণিতে ব্যথা হয়। ব়্যাশ বেরোয় । মারাত্মক ডেঙ্গির সংক্রমণ হলে উপসর্গ একটু অন্য ধরনের হয় । চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে জ্বরের সঙ্গে অস্থিসন্ধিতেও(জয়েন্টে) ব্যথা হয় । এই ব্যথা অনেক দিন পর্যন্ত থাকতে পারে ।
পাশাপাশি ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া এবং ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঘটলে, চিকিৎসা বিষয়ে তিনি বলেন, "এক্ষেত্রে জীবনের ভয় থেকে যায় । ডেঙ্গি এবং চিকুনগুনিয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই । ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসা রয়েছে । একই সঙ্গে এই তিনটি রোগের সংক্রমণ ঘটলে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা শুরু হয় । এবং ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়ার জন্য উপসর্গের ভিত্তিতে চিকিৎসা চলতে থাকে । বেশি জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয় । এই তিনটি রোগ একই সঙ্গে দেখা দিলে মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে যায় ।"
এড়ানোর উপায় হিসেবে তিনি বলেন, "মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা সঠিকভাবে করতে হবে । এডিস এবং অ্যানোফিলিস মশার জন্মস্থান একই ধরনের হয় । জন্মস্থানেই মশার বিনাশ করতে হবে । অ্যানোফিলিস মশা সাধারণত রাতে কামড়ায় আর এডিস মশা সাধারণত দিনে কামড়ায় । তবে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে ।"