পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

পরিবেশ রক্ষায় জনগণকে সচতন করতে এগিয়ে আসলেন চিকিৎসকরা - কলকাতার চিকিৎসকরা সচেতন করলেন

পরিবেশ দূষণের কারণে ক্রমশ তৈরি হচ্ছে একের পর এক মারণ রোগ ৷ তাই এবার জনগণকে সচেতন করতে সোশাল মিডিয়ায় গ্রুপ তৈরির ভাবনা চিকিৎসকদের ৷

photo
ছবি

By

Published : Dec 19, 2019, 1:50 PM IST

কলকাতা, 18 ডিসেম্বর: ক্রমে আরও দূষিত হয়ে পড়ছে পরিবেশ । বাতাস হয়ে উঠে আরও বেশি বিষাক্ত । যার জেরে, ফুসফুসের ক্যান্সার থেকে শুরু করে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের হারও বেড়েই চলেছে । রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও । আয়ু কমছে মানুষের । তাই এবার ক্রাউড সোর্সিংয়ের মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে চাইছেন কলকাতার কয়েকজন চিকিৎসক । দূষিত এমন পরিবেশের কারণে শংকিত এই চিকিৎসকরা সোশাল মিডিয়ায় গ্রুপ তৈরি করে মানুষকে আরও সচেতন করে তুলতে চাইছেন । শুধুমাত্র তাই নয়, যে কারণে ঘটছে পরিবেশ দূষণ, তার ছবি বা ভিডিও তুলে গ্রুপে পোস্ট-ও করা হবে ।

ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপে তৈরি হয়েছে এই গ্রুপ । নাম দেওয়া হয়েছে পলিউশন অ্যালার্ট । বর্তমানে কলকাতার বেসরকারি একটি হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিসিন বিভাগের প্রধান হিসাবে কর্মরত রয়েছেন ডাক্তার সংযুক্তা দত্ত । সোসাইটি ফর ইমার্জেন্সি মেডিসিন ইন্ডিয়া-র ওয়েস্ট বেঙ্গল চ্যাপ্টারের তিনি সদ্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট । ছোট থেকে বড়, সকলেই যেভাবে দূষিত পরিবেশের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তার থেকে মুক্তি পেতে পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন এই চিকিৎসক । এই ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কলকাতার আরও কয়েকজন চিকিৎসক । নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ফেসবুকে তাঁরা তৈরি করেছেন এই গ্রুপ । পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে এই গ্রুপকে পাবলিক প্ল‍্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন তাঁরা ।

কেন এই ধরনের ভাবনা-চিন্তা?

চিকিৎসক সংযুক্তা দত্ত বলেন, " ইমারজেন্সি বিভাগে বহু বছর ধরে আমি রোগীদের দেখছি । ইদানিং দেখা যাচ্ছে, চেস্টের পেশেন্ট অনেক বেড়ে গিয়েছে । শ্বাসকষ্ট নিয়ে এত বেশি রোগী আসছেন হাসপাতালে, যেটা আমরা আগে কোনও দিন দেখিনি । ছোটদের নিয়ে আসা হচ্ছে যাদেরকে নেবুলাইজেশন দিতে হচ্ছে, ইনহেলার প্রেসক্রাইব করতে হচ্ছে ।" তিনি আরও বলেন, " আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মনে পড়ে না আমার কোনও বন্ধুকে অক্সিজেন কিংবা নেবুলাইজেশন দেওয়ার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । এইসব এখন খুব স্বাভাবিক ভাবে দেখা যাচ্ছে । ছোটদের 30-40 শতাংশ এখন দূষণের শিকার । এটা কিন্তু ভয়ের বিষয় ।" যাঁদের অ্যাজমা, COPD (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) রয়েছে, শীতকালে তাঁদের চেস্টের সমস্যা বেড়ে যায় । এবং, তাঁদেরকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় । এ কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, " ইদানিং আমি দেখছি 30-40-50 যে কোনও বয়সের মানুষকে নিয়ে আসা হচ্ছে হাসপাতালে । হয়তো একটু সর্দি, কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে । এক্স-রে করে দেখা গেল চেস্টের অবস্থা খুব খারাপ । এটা দেখে আমি নিজে ভীত । আমার নিজের, আমার পরিবার, আমার সন্তান, চারপাশে আমার ভালোবাসার মানুষগুলির অবস্থাটা কী রকম হচ্ছে, এটা ভেবেই আশঙ্কিত ।" তিনি বলেন, " আজকে হয়তো একটি শিশুকে ওষুধ, নেবুলাইজেশন দেওয়া হল । তার মা-বাবা মনে করলেন, জ্বর হয়েছিল সেরে গেছে । তেমনটা কিন্তু নয় । এটার লং টার্ম এফেক্ট থাকবে । শিশুকর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে । সুতরাং, এক্ষেত্রে পার্মানেন্ট এফেক্ট থাকবে ।"

ভিডিয়োয় শুনুন বক্তব্য

চিকিৎসক সংযুক্তা দত্ত বলেন, " কিন্তু যদি প্রচুর মানুষকে সচেতন করা যায় । তাহলে লোকজন জানবেন আমরা কী ক্ষতিকর পরিবেশের মধ্যে আছি ।" তিনি বলেন, " যতক্ষণ না কেউ জানবেন সমস্যার মধ্যে রয়েছেন, ততক্ষণ সমস্যার সমাধান কীভাবে খুঁজবেন । আজকে যদি সমস্যা চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে হয়তো তার সমাধানটা খুঁজতেও পারব ।" দূষিত পরিবেশের কারণে পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে যে, বহু মানুষকে এলার্জির ওষুধ দিতে হচ্ছে। দূষিত পরিবেশের কারণে চোখ, নাক, গলা, বুক জ্বালা করছে, শ্বাসনালী জ্বালা করছে, ব্যথা করছে, খুসখুসে কাশি রয়েছে দিনের পর দিন ধরে, কমছে না ।

এই কথা জানিয়ে চিকিৎসক সংযুক্তা দত্ত বলেন, " সাধারণ মানুষকে সচেতন করে আমরা যদি আরও ভালোর কিছু করার লক্ষ‍্যে রাস্তা খুঁজতে পারি, এই জন্যই এই গ্রুপটি তৈরি করা হয়েছে । এটাকে আমরা একটি পাবলিক প্লাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করছি । এই গ্রুপে যিনি জয়েন করবেন, এই গ্রুপ তাঁর নিজস্বও । কারণ, আমরা সকলেই দূষিত পরিবেশের কার ণে বিষাক্ত বাতাস গ্রহণ করছি।" তবে, শুধুমাত্র ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপে এই গ্রুপ তৈরি করা নয় । স্কুল-কলেজ, ক্লাব, কর্পোরেট সেক্টরেও তাঁরা যাবেন । এই সব স্থানে তাঁরা বোঝাবেন, বিষাক্ত বাতাস কীভাবে, কতটা ক্ষতি করে চলেছে প্রতিদিন ।"

দূষিত পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব কী কী হতে পারে এবং এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রতিরোধ হিসাবে কী কী করা উচিত ?
এই চিকিৎসক বলেন, "সবাই হয়তো টাকা ইনকামের পিছনে ছুটছেন । সবাই হয়তো তাঁর সন্তানের জন্য টাকা সঞ্চয় করছেন । কিন্তু, একবারও ভাবছেন না, বাচ্চার ফুসফুস সেভ করা যাচ্ছে কি না । বাচ্চার ফুসফুস যদি সেভ করতে না পারি, হতে পারে আপনার সেভ করা টাকা আপনার বাচ্চার ব্যবহার করার ক্ষমতা থাকল না । এটা খুব অ্যালার্মিং সিচুয়েশন । আমার মনে হয়, সবাইকে সতর্ক হতে হবে । এবং, সবাইকে পদক্ষেপ নিতে হবে ।" এই চিকিৎসক বলেন, " না জন্মানো বাচ্চার প্লাসেন্টায় কার্বনের গুঁড়ো পাওয়া গিয়েছে । এটা থেকে বোঝা যায় কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে পরিবেশ । দূষিত পরিবেশের কারণে চোখ জ্বালা করছে, গলা খুসখুস করছে, শুকনো কাশি চলছে, থামছে না। নাক জ্বালা করছে, নাক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এর পরের স্টেজে ইনফেকশনের সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায় । দূষিত পরিবেশের কারণে আমাদের ইমিউনিটি পাওয়ার কমে যায়। খুব চট করে ফুসফুস, শ্বাসনালীর উপরের অংশে ইনফেকশন হয়ে যায়। এর থেকেও বাড়াবাড়ি, যেগুলি আমরা দেখতে পাচ্ছি তা হল কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ। হার্টের অনেক অসুখ দূষণের জন্য বেড়ে যায়, স্ট্রোক হয়, এমনকী প্রিম্যাচিউর ডেথ অর্থাৎ, আমাদের যতটা আয়ু হওয়া উচিত, তার থেকে কমে যাচ্ছে ।"

চিকিৎসকদের এই দলে রয়েছেন কনসালট‍্যান্ট হেমাটোলজিস্ট, চিকিৎসক প্রান্তর চক্রবর্তী । তিনি বলেন, " প্রায় ১৯ বছর আগে, আমি তখন ইন্টারনাল মেডিসিনে পাঠ নিয়ে একটি হাসপাতালে কাজ করছিলাম । তখন শীতকাল ছিল । আমরা বুঝতে পারলাম কলকাতার বাতাসে এমন কিছু জিনিস রয়েছে, যেগুলি ক্ষতি করে চলেছে ।" তিনি বলেন, "2001-এ দূষন নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে স্টাডি শুরু হয়েছিল কোন কোন কারণে মানুষ হাসপাতালে ভরতি হচ্ছেন । শ্মশানে, কবরখানায় যেসব মৃতদেহ আসছে, সেই সব মৃত্যুর কারণ কী। " এই স্টাডির সঙ্গে তিনি ছিলেন । এ কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, " যেটুকু দেখতে পেয়েছিলাম তা ছিল ভয়ানক । তখন যে প্যারামিটার ছিল তার নিরিখে বাতাসের মান ছিল দ্বিগুণ খারাপ । এই কারণে শীতকালে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। এখন অবাক হয়ে দেখছি, ফলাফল দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, তথ্য যা দেখছি তখন যা ছিল তার থেকে এয়ার কোয়ালিটি আরও বেশি খারাপ ।"

চিকিৎসক প্রান্তর চক্রবর্তী বলেন, " সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন বিষয় অ্যাক্টিভিটি দেখা যায় । তাহলে এই বিষয়টি নিয়ে কেন হৈ চৈ হচ্ছে না? একটি কারণ হতে পারে যে, মানুষ বুঝতেই পারছেন না পরিবেশ দূষণের বিষয়টি নিয়ে হৈ চৈ হওয়া দরকার । অন্য একটি কারণ হতে পারে পজিটিভ রিইনফোর্সমেন্ট হচ্ছে না ।" তিনি বলেন, "এই গ্রুপের মাধ্যমে মানুষকে বোঝানো হবে আজকে কলকাতার এয়ার কোয়ালিটি যে রকম, তাতে আপনার এত মাস আয়ু গেল, আপনার ফুসফুসের ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের সম্ভাবনা এত শতাংশ বেড়ে গেল । আমরা যতক্ষণ না ভয় পাব, মনে হয় না ততক্ষণ কিছু করব ।" শুধুমাত্র তাই নয় । তিনি বলেন, " কোথাও হয়তো দেখা গেল কালো ধোঁয়া ছাড়ছে কোনও গাড়ি। গান্ধীগিরির অঙ্গ হিসাবে ওই গাড়ির ছবি বা ভিডিও তুলে আমরা পোস্ট করব । যাতে এই পোস্টটি দেখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি লজ্জা পান যে তিনি দোষী । এই গ্রুপের সদস্য হিসাবে যিনি সব থেকে বেশি পোস্ট করবেন, তাঁকে সম্মান জানানো হবে । সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা অনেক অ্যাওয়ারনেস ক্রিয়েট করছি । একটা ভালো কাজ দিয়ে যদি একটা খারাপ কাজের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হয়, তার জন্য আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে ।"

ABOUT THE AUTHOR

...view details