কলকাতা, 30 জুলাই : অপারেশন থিয়েটারে রোগী গান শুনছেন অথবা গাইছেন । কিংবা, বাজাচ্ছেন কোনও বাদ্যযন্ত্র । রোগী জানেন তাঁর অপারেশন চলছে । আর, এই ধরনের অপারেশনের পরে, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে খোশমেজাজে মেতে উঠতে পারছেন রোগী । এমন কী, দ্রুত বাড়িতেও ফিরতে পারছেন । মিউজ়িক অর্থাৎ, সুরকে সঙ্গী করে এ ভাবেই অপারেশন থিয়েটারের ধারণাটাই বদলে দিয়েছেন কলকাতার অর্থোপেডিক সার্জন, চিকিৎসক সুমন্ত ঠাকুর । আন্তর্জাতিক জোড়া স্বীকৃতি মিলল তাঁর এই স্বপ্নের প্রচেষ্টার ।
এই ধরনের অপারেশনের ক্ষেত্রে এমন অবস্থাও হয় যে, রোগী বলছেন, কী যে গান গাইলাম ! অথবা বলছেন, কী যে গান শুনলাম ! সুরের মূর্ছনায় এতটাই বিভোর হয়ে যান রোগী, যে অপারেশনের পরে তিনি চিকিৎসকের কাছে জানতে চান, তাঁর অপারেশন হয়ে গেছে কি না । বিষয়টা এমনও হয় যে, রোগীর এক হাতে হয়ত অপারেশন চলছে । আর অন্য হাতে তিনি মেতে উঠেছেন বাদ্যযন্ত্রে, কোনও গানের সুরে । চিকিৎসক সুমন্ত ঠাকুরের কথায়, "অপারেশন চলছে । আর, রোগী গান গাইছেন বা শুনছেন বা কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন । এটাই নতুনত্ব । অপারেশন থিয়েটারের চিত্রটা এক রকম হয় । সেই চিত্রটা একটু বদলে দেওয়া গেছে । এখানে আমার মূল সহযোগী হচ্ছে সুর বা মিউজ়িক । এবং দ্বিতীয় হচ্ছে কাউন্সেলিং বা কথা বলা ।" তবে, শুধুমাত্র এভাবে অপারেশন নয় । তিনি বলেন, "প্রেসক্রিপশনেও গানের কথা লিখি । যাঁদের ঘুম হয় না, ডিপ্রেশনে রয়েছেন, তাঁদের জন্য প্রেসক্রিপশনে কিছু কিছু সুরের কথা লিখি ।"
কলকাতার এই চিকিৎসকের এমন মিউজ়িক থেরাপির আন্তর্জাতিক জোড়া স্বীকৃতি মিলল এবার । মিউজ়িক থেরাপির উপর ইউনিভার্সাল রেকর্ডস ফোরাম-এর গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড 2019-এর প্রাপক এই চিকিৎসক । সম্প্রতি, ইউনিভার্সাল রেকর্ডস ফোরাম-এর তরফে চিকিৎসক সুমন্ত ঠাকুরের হাতে তাঁর এই মিউজ়িক থেরাপির স্বীকৃতি স্বরূপ শংসাপত্র এবং স্মারক তুলে দেওয়া হয়েছে । এর পাশাপাশি, 19 জুলাই অ্যামেরিকা বুক অফ রেকর্ডস-এর তরফেও এই চিকিৎসককে মেইল করে জানানো হয়েছে, মিউজ়িক থেরাপির উপর তাঁর অ্যাচিভমেন্ট শীঘ্রই অ্যামেরিকান বুক অব রেকর্ডসের তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে । আন্তর্জাতিক এই দুই স্বীকৃতির বিষয়ে চিকিৎসক সুমন্ত ঠাকুর বলেন, "এই দুই কর্তৃপক্ষ আমার রিসার্চের বিষয়টা পড়েছে, দেখেছে । পর্যালোচনার পরে, তারা নথিভুক্ত করেছে । আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ । বহুদিনের স্বপ্ন, প্রচেষ্টাকে একটা জায়গায় নিয়ে আসতে পারলাম ।"
ছোটোবেলা থেকেই অন্য ধরনের ভাবনা ঘুরে বেড়িয়েছে এই চিকিৎসকের মনে । তিনি এমন মনে করতেন, 2+2 করলে 4 হয় । কিন্তু, 2+2 না করে, 4-কে আরও কী ভাবে 4 করা যায় । ছোটোবেলা থেকে সংগীতপ্রেমী এই চিকিৎসক প্রয়াত ভি ভালসারার ছাত্র ছিলেন । গানের জগতে সক্রিয়ভাবে তাঁর যাওয়া হয়নি । তবে কখনও কখনও সুযোগ পেলে তিনি গানবাজনা করেন । তাঁর কথায়, "আমার স্যার বলেছিলেন, পারলে এটা (সুর)-কে মানবপ্রেমের কাজে লাগিও । এটা আমার মাথায় ছিল । 1998 থেকে অপারেশন থিয়েটারে মিউজ়িক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, পড়াশোনা শুরু করি । 2007 থেকে সক্রিয়ভাবে এই কাজটি করছি ।"
ছকভাঙার মানসিকতা তো রয়েছে । কিন্তু, সাধারণত যেভাবে অপারেশন থিয়েটার চলে, সেভাবে না করে কেন এভাবে অপারেশন করেন তিনি? সুমন্ত ঠাকুর বলেন, "প্রথম কথা, রোগীর যে ভয়-ভীতি বা টেনশন, যেমন, তিনি কবে ভালো হবেন, ডিপ্রেশন । এ সব থেকে রোগীকে বার করে নিয়ে আসার একটি প্রচেষ্টা । হাসপাতালের পরিবেশে হসপিটাল সিকনেস নামে একটি রোগ হয় । একটি সমস্যার সৃষ্টি হয় । এক্ষেত্রে ঘুমের বা অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ওষুধ দিতে হয় । অপারেশন চলাকালীন রোগীর ব্লাড প্রেসারে তারতম্য হতে পারে, তিনি ভয় পেতে পারেন । তখন তাঁকে আইভি চ্যানেলের মাধ্যমে ঘুমের ওষুধ দিতে হয় ।" তবে, এ ভাবেই মিউজ়িক প্রয়োগের মাধ্যমে, এ সবের কিছুরই প্রয়োজন হয় না । এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "মিউজ়িক প্রয়োগ করে এবং কথা বলে আমি যেটুকু দেখেছি, তখন কোনও ওষুধেরই প্রয়োজন হয় না । একজন রোগী স্বতঃস্ফূর্তও থাকেন । এটার জন্য সংগীতের কাছে আমি ভীষণ রকম কৃতজ্ঞ ।"
এভাবে অপারেশনের জন্য জেনেরাল অ্যানাস্থেসিয়া করা হয় না । অর্থাৎ, রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হয় না । যেখানে অপারেশনের প্রয়োজন, সেখানে অবশ করে দেওয়া হয় । মিউজ়িকের ব্যবহারের মাধ্যমে এভাবে অপারেশনের বিষয়টি নিয়ে রিসার্চ করতে থাকেন এই চিকিৎসক । রোগীকে কেন সম্পূর্ণ অজ্ঞান না করে অপারেশনের সময় এভাবে মিউজিকের ব্যবহার করা হয়? এই চিকিৎসক বলেন, "জেনেরাল অ্যানাস্থেসিয়া করলে রোগী সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে যান । এর কিছুটা হ্যাজার্ড রয়েছে । এর জন্য আমাদেরও ভয় করে যদি রোগীর কোনও অসুবিধা হয়ে যায় ।" এই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে, ঘুমের ওষুধ দেওয়ার দরকার নেই এমন ভাবে অপারেশনের কথা ভাবেন তিনি । এই চিকিৎসকের কথায়, "শুধুমাত্র সঠিকভাবে যদি মিউজ়িককে ব্যবহার করা যায়, রোগীর সঙ্গে যদি সঠিক ভাবে কথাবার্তা বলা যায় । তাহলে রোগী অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত থাকেন । পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য তাঁর খরচ কম হয় । হাসতে হাসতে রোগী অপারেশন থিয়েটারে ঢোকেন । হাসতে হাসতে বের হন । অপারেশনের কিছু ক্ষণ পরেই রোগীকে খাবার দিয়ে দেওয়া যেতে পারে ।"
তিনি বলেন, "জেনেরাল অ্যানাস্থেসিয়ায় কিছু কিছু সমস্যা হতে দেখেছি । আমার নিজেরও ভয় ছিল । এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিই, রোগীকে আমরা জ্ঞানেই রাখব ।" কত শতাংশ সফল? তাঁর কথায়, "10 জনের মধ্যে 8 জন রেসপন্স করেন । দু'জনের রেসপন্স সেরকম আমরা হয়ত পাই না । সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় । 80-85 শতাংশ ক্ষেত্রে এটা সফল । কোনও ভয়-ভীতি কিছু থাকে না ।"
কী ভাবে অপারেশন করা হয়?
এই চিকিৎসক বলেন, "রোগীকে ভরতি করানোর পরে প্রথমে তাঁর বন্ধু হয়ে যেতে হবে । তার কী রোগ, জটিলতা কতটা, এসব বিষয়ে রোগীর সামনে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা না করে, রোগীকে তাঁর দুশ্চিন্তার জায়গা থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে । তাঁর সঙ্গে অন্য কথা বলে অন্য গল্প করে, ভালো লাগা, না ভালোলাগা জেনে নিতে হবে । রোগীর হবি কী, এগুলো জেনে নিয়ে, সেগুলি নিয়ে বেশি কথা বলা । এ সবের কারণে রোগী অনেকটা রিলিফ হয়ে যান ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "আমি তাঁকে একটি দুনিয়া থেকে অন্য একটি দুনিয়ায় নিয়ে আসি । যেটা হচ্ছে গানের দুনিয়া । রোগী এখানে অপারেশনের আগেই মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যান । না হলে, একদিন বা দুই দিনের মধ্যে একজন রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে গান গাওয়ানো, বা বাজনা বাজানো সম্ভব নয় ।"