কলকাতা, 11 এপ্রিল: প্রতিবাদের সুর আজও যাঁর গলায় সপ্তমে ওঠে তাঁর নাম বিমান বসু (Biman Basu leaves Politburo)। দৃপ্তভঙ্গীতে প্রতিটি পদক্ষেপে যিনি মিছিলের অভিমুখ এঁকে দেন, তিনি বিমান বসু । শহর, গ্রাম, রাজ্য, দেশের প্রতিটি অলিগলি যাঁর হাতের তালুর মতো চেনা, তিনি বিমান বসু । চেহারায় ছোটখাটো কিন্তু ব্যক্তিত্বে হিমালয়সম মানুষটি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের রাজ্য সদর দফতরে বর্তমান সময়ে অভিভাবকের মতো । রবিবার সিপিএম পার্টি কংগ্রেসের শেষদিনে এই মানুষটি বারবার ফিরে গেলেন অতীতে ৷ ছাড়লেন পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ (Biman Basu leaves CPM central committee membership)৷
পার্টি কর্মসূচিতে (CPM latest news) অক্লান্ত মানুষটি শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় ছুটে বেড়ান । অক্লান্ত মানুষটি বলেন, যে দিন শরীর দেবে না সে দিন আর বেরোব না । মঞ্চ থেকে ছোট লাফে নেমে পড়া, তড়তড়িয়ে সিড়ি ভাঙায় আজও যে কোনও তরুণকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন । সিপিএম সদর দফতরের ছাদে একফালি বাগান রয়েছে । সেখানে নানান ফুল এবং ফলের সমাহার । একফালি বাগানের মালি বিমান বসু । প্রতিদিন গাছের পরিচর্যায় সময় দেন । সেই গাছে ফল ধরলে বা ফুল ফুটলে তৃপ্তি ফুটে ওঠে ওঁর মুখে । অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় এই বাড়িতেই তাঁর বাস । দলের বিভিন্ন দফতর সামলে আজ শীর্ষে । অভিভাবক । আপাত কঠিন ব্যক্তিত্বের মধ্যে নরম সংবেদনশীল মন লুকিয়ে, তার প্রমাণ বহুবার মিলেছে । নতুনকে এগিয়ে দিতে তিনি সবসময়ই উদারমনা । বলেন, নতুনের পায়ে আগামীর শব্দ শোনা যায় ।
বাড়ি ছাড়ার পরে প্রথমে বেনিয়াপুকুরে কৃষকসভার অফিসে উঠেছিলেন (Biman Basu retires)। পরে প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে পাকাপাকি থাকতে শুরু করেন । এখন সেটাই তাঁর ঘরবাড়ি, কর্মী-কমরেডরা পরমাত্মীয় । কান্নুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ”এতদিন আমিই পার্টির সব জানতাম । কাউকে কিছু জানাতে হত না । এখন পার্টি আমাকে যা বলবে, সেটাই করব । পার্টিই করব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত । কারণ, আমার তো পার্টি ছাড়া আর কিছু নেই ।”
আরও পড়ুন: Durga Puja : বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর আবেদন বিমানের, কোভিড সচেতনতার কথা সূর্যকান্তের
পার্টি কংগ্রেসের শেষদিন লালে সেজে ওঠা কান্নুরের রং ফিকে । আর অস্তগামী সূর্যের মতোই ম্লান দেখাল তিরাশির ‘তরুণ’ বিমান বসুকে । কয়েকদিন আগে বিমান বসুর স্মৃতিতে উঠে এসেছিল মা'য়ের কথা ৷ বলেন, "মাকে আমি খুব ভালবাসতাম । তার জন্যই কমিউনিস্ট পার্টিতে আসা । সেই মাকেই আমি নাকি জন্মের সময় খুব কষ্ট দিয়েছিলাম । পরিবারের বড়দের মুখে শুনেছি । আমি যখন গর্ভে, পূর্ববঙ্গ থেকে মাকে নিয়ে বাবা স্টিমারে গোয়ালন্দ হয়ে ট্রেনে কলকাতা এসেছিলেন । শুনেছি, স্টিমারযাত্রায় মায়ের রক্তক্ষরণ হয় । ট্রেনে উঠে রক্ত বন্ধ হয় । কলকাতায় এসে তখনকার ক্যাম্পবেল হাসপাতালের নামী ডাক্তার নীলরতন সরকারের কাছে বাবা লিখে পাঠিয়েছিলেন মাকে পরীক্ষা করাতে । প্রসবের সময় আর পাঁচটা শিশুর মতো আমার মাথা আগে বেরোয়নি, বেরিয়েছিল পা । আর কষ্ট পেয়েছিলাম সেই মাকেই যখন ছেড়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হলাম । বাড়ি ছাড়লাম ।”
জীবনে রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নেই । নিঃশ্বাস এবং প্রশ্বাসে শুধুই শ্রেণি সংগ্রাম, শোষিতের জন্য লড়াই । শয়নে, স্বপনে এবং জাগরণে শুধুই সাম্যবাদের গান । সকালের কৈশোর থেকে সন্ধের অবসর, পুরোটাই রাজনীতিতে নিবেদিত বিমান বসুর । বামফ্রন্ট চেয়ারম্যানের । বঙ্গ সিপিএমের প্রাক্তন সম্পাদকের । সিপিএম পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদ্যপ্রাক্তন সদস্যের । রবিবার কেরালার কান্নুরে সিপিএম পার্টি কংগ্রেসের শেষদিনেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন কার্যত সমাপ্তির পথে এগিয়ে গেল কয়েক ধাপ । পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ ছাড়তে হল বয়সের কারণে । তবে কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে থাকবেন তিনি । 1985 সালে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ পেয়েছিলেন বিমান বসু । তখন তাঁর বয়স ছিল 46 এর আশেপাশে । পলিটব্যুরোর সদস্য হন 1998 সালে । এখন তিনি তিরাশি । বয়সের কারণেই ছাড়তে হল আলিমুদ্দিনের একমাত্র বাসিন্দাকে । রবিবার 23তম পার্টি কংগ্রেসের নয়া সিদ্ধান্তের পর এই মুহূর্তে বিমান বসুর পদ বলতে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান এবং সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য ।
আরও পড়ুন:Biman Bose in Rampurhat: বগটুইতে পৌঁছলেও পুলিশি বাধার মুখে প্রবীণ বামনেতা বিমান বসু
এই বিদায়বেলায় বারবার তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন অতীতে, রাজনৈতিক জীবনের শুরুর দিনগুলিতে । কান্নুরের ইকে নয়নার নগরে লালে মোড়া চত্বরে দাঁড়িয়ে বারবার তাঁর মনে পড়ছিল মায়ের কথা । মা কী বলতেন, কীভাবে সংস্কার ছড়িয়ে গিয়েছিল পরিবারে, সে সব শোনা গেল । বললেন, ”শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত পার্টি করব । পার্টি ছাড়া আর কিছু নেই ।”