বাংলা কোনও কালেই কোনও নির্বাচনে এত ঘন ঘন দেশের কোনও প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রাজ্যে এভাবে চক্কর কাটতে দেখেনি ৷ দলে দলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের এভাবে জেলায় জেলায় পাক খেতেও দেখেনি ৷ আর এসব দেখে এবং শীর্ষ নেতাদের বক্তৃতা শুনে এ রাজ্যের বিজেপি কর্মী- সমর্থকদের মধ্যে এক উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল, ক্ষমতায় এবার আসছিই ৷ ধারণা হয়েছিল, দলের শীর্ষ-নেতৃত্ব যখন বলছেন, তখন নিশ্চিতভাবেই কমপক্ষে 200 আসন নিয়ে বাংলার ক্ষমতায় আসছে বিজেপি ৷
এই 'ধরে নেওয়া' অন্যায় কখনওই নয় ৷ মোদি-শাহ স্তরের নেতারা যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা 'বিশ্বাস' করছেন কর্মী-সমর্থকরা ৷ ডেডিকেটেড কর্মীরা তো এমনই হন ৷ বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করলেও, নেতৃত্বের বার্তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা অনুচিত ভাবেন তাঁরা ৷ তাই শপথ নেওয়াটাই যা বাকি রেখেছেন ভক্তরা ৷ বাকি কাজ 'কমপ্লিট' ছিল ৷
কিন্তু হল না ৷ 200 তো অনেক দূর, ম্যাজিক ফিগারের অর্ধেকও জুটল না বিজেপির পাত্রে ৷
মোদি'জি বা শাহ'জিদের এমন ব্যস্ততা বাংলা অতীতে না দেখলেও, একই ছবি অথবা এর থেকেও বেশি দাপাদাপি দু-দু'বার দিল্লিবাসী দেখেছেন ৷ 2015 এবং 2020 সালের দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে ৷
এই একই কায়দায় মোদি-শাহ বাহিনীর ওই ঘোরাঘুরির নিট ফল কী হয়েছিল, তা অনেকেই এখন মনে রাখতে চান না ৷ তবে না চাইলেও সেটা তো বাস্তব ৷ দিল্লির মোট লোকসভা আসন 7টি ৷ 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে সবক'টিই দখল করে বিজেপি ৷ সবকটি আসনপ্রাপ্তির ওই গরমে ঠিক পরের বছর, 2020-এর দিল্লি ভোটে বিজেপি 100 শতাংশ নিশ্চিত ছিল এবার ক্ষমতা দখল হচ্ছেই ৷ অথচ ফলপ্রকাশের পর দেখা যায় দিল্লির 70 আসনের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ঘরে তুলতে পেরেছে মাত্র 8টি আসন ৷
একটু খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হয়, 42-এর মধ্যে 18 আসন পাওয়া বাংলা নিয়েও এক ছাঁছে ফেলেই অঙ্ক কষছে বিজেপি'র থিঙ্ক- ট্যাঙ্করা ৷ এখানেই ডুবেছে গেরুয়া বাহিনী ৷ বাংলার বিজেপি নেতাদের সঙ্গে ন্যূনতম আলোচনা না করেই একের পর এক দিল্লি-টাইপ কৌশল রচনা করে ৷ বাংলার পালস বোঝার চেষ্টাই করেনি ৷ দিল্লির ধাঁচে খেলা সাজিয়ে, দিল্লির রেজাল্ট নিয়েই এবারের মতো ঘরে ফিরল বিজেপি ৷ পরবর্তী লড়াই 2024-এর লোকসভা ভোটে ৷ মাঝে অবশ্য কলকাতা, হাওড়া-সহ শতাধিক পৌরসভার ভোটে লড়ার সুযোগ পাবে বঙ্গ বিজেপি ৷ ওইসব ভোটে হয়তো এতখানি তৎপরতা দেখাবে না দিল্লির নেতারা ৷
আরও পড়ুন : কাজে এল না সিদ্দিকি টনিক, এই প্রথম বিধানসভা বাম-কংগ্রেসহীন
মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দিল্লিতে বিজেপি পরপর দু'বার গো-হারা হেরেছে ৷ 2014-তে দিল্লিতে ক্ষমতায় আসে বিজেপি ৷ 2015-তে দিল্লি বিধানসভার ভোট ৷ বিজেপির গায়ে তখনও নতুন বৌ-এর গন্ধ ৷ ফলে গেরুয়া বাহিনী নিশ্চিত ছিল, দিল্লি এবার দখলে আসবেই ৷ ফল প্রকাশের পর দেখা যায় 70টি আসনের মধ্যে 3টি এবং পরেরবার 2020 সালের ভোটে তো 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ' ঘোষণা করে 5টি আসন বাড়াতে পেরেছিলেন মোদিজি- শাহজি ৷ দিল্লিতে আপাতত ওটাই চূড়ান্ত সাফল্য ৷
রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ কেজরির কাছে ওই ভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার কারণ একাধিক ৷ এবং আশ্চর্যের বিষয় সেই কারণগুলি থেকে কোনও 'শিক্ষা' না নিয়েই বাংলার ভোটেও দিল্লির স্ট্র্যাটেজিই 'কপি-পেস্ট' কেন করছে গেরুয়া নেতৃত্ব, তা বোঝা অসম্ভব ৷ দিল্লিতে আছাড় খাওয়া ফরমূলার সঙ্গে বাংলার 'ক্ষমতা-দখল' করার লক্ষ্যে তৈরি ফরমূলার অসম্ভব মিল রয়েছে ৷ আর ভোট কৌশলের ওই মিল যে এভাবে ফল প্রকাশের দেখা দেবে তা সেদিন বুঝতে চেষ্টাই করেননি মোদি-শাহ ৷ বাংলার মহারণে মাত্র 71 আসন লাভের পর এখন দিল্লিতে বসে নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে বুঝছেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ ৷
◾ 'মোদিজিকে প্রধানমন্ত্রী করার ভোট' আর 'মোদিজির কথায় অন্য কাউকে ভোট' দেওয়া এক নয় ৷ দিল্লিতে 2015 এবং 2020, দু'বারের ভোটে বিজেপি তা বোঝেনি ৷ বিজেপি 2021-এ সেই ফরমূলাই বঙ্গ-ভোটে প্রয়োগ করেছে ৷ এবং ডুবেছে ৷