কলকাতা, 26 মার্চ : শনিবার রাজ্যে প্রথম দফার ভোট ৷ পাঁচ জেলা মিলিয়ে মোট 30 টি বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষ নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করবেন ৷ এর মধ্যে রয়েছে জঙ্গলমহলের একটি বড় অংশ ৷ নির্বাচনে ঘিরে দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় থাকছে কড়া নিরাপত্তা ৷ বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে দুই মেদিনীপুরের দিকে ৷ কোনওরকম অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে সজাগ নির্বাচন কমিশন ৷
প্রথম দফায় মোট 10, 288 টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্র থাকছে ৷ প্রতিটি কেন্দ্রে নিরাপত্তা আটসাঁট করা হয়েছে ৷ 732 কম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে ৷ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে তিনজন বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে নির্বাচন কমিশন । কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে থাকছে 11 হাজারের বেশি রাজ্য পুলিশ ।
জঙ্গলমহলের কথা উঠলেই রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের কথা প্রথম মাথায় আসে ৷ এখানে মাটির নিচে দিয়ে জল নয়, রক্ত বয়ে যায় ৷ সেখানে দাঁড়িয়ে এত সংখ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হলেও মানুষের মনের ভয় কী আদৌ কমবে ? বিশেষ করে গড়বেতা বা শালবনির মতো কেন্দ্রগুলির মানুষেরা কি পুরানো আতঙ্কের কথা ভুলে গণতন্ত্রের উৎসবে অংশ নেবেন ? এককালে মাওবাদী অধ্যুষিত বিনপুর, নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঘমুণ্ডি, বলরামপুর বা বান্দোয়ানের মতো কেন্দ্রগুলির মানুষই বা কি ভাবছেন ?
তবে সবদিকেই সজাগ নজর রাখছে নির্বাচন কমিশন ৷ তিন থেকে চারটি বুথ রয়েছে যে কেন্দ্রগুলিতে সেখানে 8 জন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান রাখা হবে । পাঁচ থেকে আটটি বুথ রয়েছে যে কেন্দ্রগুলিতে সেখানে 12 জন জওয়ান থাকবেন । আর যেসব কেন্দ্রগুলিতে 15টির বেশি ভোটগ্রহণকেন্দ্র রয়েছে, সেখানে 16 জন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান থাকবেন ।
গণতন্ত্রের এই উৎসব নিঃসন্দেহে মানুষের কাছে নতুন আশার আলো নিয়ে আসে ৷ কিন্তু বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সিপিএম নেতারা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উভয়েই জানেন, জঙ্গলমহলের রাজনীতির কতটা রক্তক্ষয়ী ইতিহাস রয়েছে ৷ গড়বেতা বা শালবনির মতো আসনগুলির ক্ষত এখনও দগদগে ৷ গড়বেতার সিপিএম প্রার্থী তপন ঘোষ এবং শালবনির সিপিএম প্রার্থী সুশান্ত ঘোষের থেকে ভাল হয়ত সেকথা আর কেউ জানেন না ৷
আরও পড়ুন :প্রথম দফায় নজর থাকবে যাঁদের উপর
এই দুই কেন্দ্রে যতবারই ভোট হয়, 2001 সালের 4 জানুয়ারির আতঙ্ক যেন প্রতিবার ফিরে ফিরে আসে ৷ শনিবারও সেই আতঙ্কের স্মৃতি আরও একবার দেখা যাবে ৷ গড়বেতার ছোট-অঙ্গারিয়া গ্রাম সেই রাতে রক্তে ভিজেছিল ৷ একাধিক তৃণমূল সমর্থককে গুলি করে হত্যা করেছিল একদল দুষ্কৃতী ৷ অভিযোগ ছিল, তারা প্রত্যেকে সিপিএম আশ্রিত ৷
সেই সময় সুশান্ত ঘোষ ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ৷ আর তাঁর দুই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠের মধ্যে ছিলেন তপন ঘোষ এবং সিপিএমের জ়োনাল কমিটির সেক্রেটারি সুকুর আলি ৷ তৃণমূল শিবিরের অনেকেই বলেন, সেই রাতে গড়বেতার হত্যাকাণ্ডে মাথা ছিলেন এই দু'জন ৷ অভিযোগ উঠেছিল সুশান্ত ঘোষের বিরুদ্ধে ৷ গড়বেতায় মাটির তলা থেকে কঙ্কাল উদ্ধারের ঘটনায় সরাসরি নাম জড়িয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে ৷ সিপিএম তাঁকে সাসপেন্ডও করেছিল ৷
2002 সালে বেনাচাপড়ায় সুশান্ত ঘোষের বাড়ির একেবারে কাছেই মাটি খুঁড়ে সাতটি কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছিল ৷ তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধ লুকানোর অভিযোগ এনেছিল পুলিশ ৷ উল্লেখ্য 1987 সাল থেকে সুশান্ত ঘোষ রাজ্যের বিধায়ক ৷
কিন্তু এই সুশান্ত ঘোষই 2001 সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেশপুর সিপিএমের শেষপুর স্লোগানকে বেশ দক্ষহাতে সামাল দিয়েছিলেন ৷ 2011 সালের তৃণমূল ঝড়কেও দক্ষ হাতে মোকাবিলা করেছিলেন ৷ তবে 2016 আসতে আসতে আদালতের নির্দেশে পশ্চিম মেদিনীপুরে ঢোকা বন্ধ হয়ে যায় সুশান্ত ঘোষের জন্য ৷ হাতছাড়া হল গড়বেতা ৷ 61 হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল ৷ ভোটের চাকা ঘুরতে ঘুরতে আরও তিন বছর কেটে গেল ৷ 2019 সাল ৷ লোকসভা নির্বাচন ৷ এই গড়বেতা কেন্দ্র থেকেই তৃণমূলকে প্রায় 8 হাজার ভোটে পিছনে ফেলে দেয় বিজেপি ৷
আরও পড়ুন : কোন কেন্দ্রে কোন সৈনিক ! প্রার্থীদের এক ঝলক
এই পরিস্থিতিতে সিপিএম বিলক্ষণ বুঝতে পারছে, হারানো দূর্গ ফিরে পেতে জঙ্গলমহলের রাজনীতিতে পোড় খাওয়া মুখেই ভরসা রাখতে হবে ৷ আর সেই কারণেই সুশান্ত ঘোষ, তপন ঘোষ বা হিমাংশু দাসের মতো নেতাদের উপরেই বাজি ধরছে শালবনি, গড়বেতা বা খেজুরির মতো কেন্দ্রগুলির জন্য ৷ প্রত্যেকেই এর আগেও জঙ্গলমহলের লাল দূর্গের হয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলেন ৷ শনিবার ফের একবার ভোটযুদ্ধের ময়দানে নামতে চলেছেন তাঁরা ৷
প্রথম দফায় যে 30 টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে, সেখানে বিজেপি সদ্য তাদের পায়ের তলায় মাটি পেয়েছে ৷ 2016-র ভোটে, এই 30 টি কেন্দ্রের মধ্যে 27 টিই ছিল তৃণমূলের দখলে ৷ কংগ্রেস পেয়েছিল 2 টি আসন ৷ আর বামেরা পেয়েছিল একটি ৷ বিজেপি তখনও জঙ্গলমহলে খাতা খুলতে পারেনি ৷ কিন্তু 2019-এর লোকসভা ভোটে অঙ্কের পুরো হিসেবটা পাল্টে যায় ৷ 30 টির মধ্যে 20 টিতেই এগিয়ে যায় বিজেপি ৷ মেরেকেটে 10 টি আসনে এগিয়ে ছিল তৃণমূল ৷ বামফ্রন্ট বা কংগ্রেস কেউই দাঁত ফোটাতে পারেনি একটি কেন্দ্রেও ৷
পূর্ব মেদিনীপুরের 6 টি আসন ছাড়া মমতা শুধুমাত্র ঝাড়গ্রামের বিনপুর আসনেই এগিয়ে ছিলেন লোকসভা ভোটে ৷ বাকি প্রতিটি কেন্দ্রেই কার্যত ঝোড়া হাওয়া বইয়ে দিয়ে গিয়েছে গেরুয়া শিবির ৷ ভোট শতাংশের নিরিখেও এক লাফে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি ৷ 2016-র বিধানসভা ভোটে যেখানে খুব বেশি হলে 3 শতাংশ ভোট ছিল, সেখান থেকে 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে একেবারে 38 শতাংশে পৌঁছায় বিজেপির ভোট ৷ এই পরিস্থিতিতে জঙ্গলমহলের ভোট ফের একবার বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য ৷