কলকাতা, 25 জুন : ইতিমধ্যেই শহরের বুকে হইচই ফেলে দিয়েছে ভুয়ো ভ্যাকসিন কাণ্ড । নিজেকে কখনও আইএএস অফিসার, কখনও রাজ্য সরকারের যুগ্মসচিব, আবার কখনও যুগ্ম পৌর কমিশনার পরিচয় দিয়ে তিনি বিচরণ করেছেন রাজ্যের প্রভাবশালী মানুষদের বৃত্তে । সবচেয়ে বড় কথা তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতার ছবি পাওয়া গিয়েছে । আজ এই জায়গা থেকে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে কি তৃণমূলের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে এই প্রতারক ?
বিশেষ করে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকার এই বিষয় নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে কাঠগড়ায় তুলেছেন । তাঁদের অভিযোগ, এতজন মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করা হয়েছে ৷ এই অবস্থায় রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ওই নেতারা কোনওভাবেই তাঁদের দায় অস্বীকার করতে পারে না । তাঁদের এও অভিযোগ, প্রথম সারির তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ না পেলে এত বড় পদক্ষেপ করতে সাহস পেত না দেবাঞ্জন ।
এই প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হলে তাঁরা অধিকাংশই এই ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে এড়িয়ে যান । তৃণমূল সাংসদ তথা চিকিৎসক শান্তনু সেন তো তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছেন । কিন্তু এরপরেও প্রশ্ন থাকছে, কীভাবে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে পৌঁছে গেল এই ভুয়ো আইএএস অফিসার ।
আরও পড়ুন : Fake IAS : একাধিক মহিলা সাগরেদ থাকার অনুমান, কত বড় চক্র ছিল দেবাঞ্জনের ?
এ প্রসঙ্গে তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন স্পষ্টভাষায় জানিয়েছেন, তিনি এই ব্যক্তিকে কোনওভাবেই কখনও দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না । সাংসদ জানান, "আইএমএ-র তরফ থেকে গত দেড় বছর ধরে একাধিক কর্মসূচি হয়েছে ৷ সাধারণ মানুষকে মাস্ক স্যানিটাইজ়ার, পালস অক্সিমিটার সহ একাধিক জিনিসপত্র দেওয়া হয়েছে । কিছু কিছু উৎসাহী ব্যক্তি আইএমএ-র মাধ্যমে তাঁদের দ্রব্যাদি মানুষের কাছে বিতরণ করতে চেয়েছেন ৷ আমরা তাতেও সাহায্য করেছি । এই রকম কোনও অনুষ্ঠানের মঞ্চে দেবাঞ্জন ছবি তুলে থাকলে ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু করার নেই ৷"
একই সুর শোনা গিয়েছে অভিনেত্রী তথা তৃণমূল বিধায়ক লাভলী মৈত্রের গলায় । তাঁর কথায়, ব্যক্তিগতভাবে দেবাঞ্জন দেবকে তিনি চেনেন না । অভিনেত্রী বিধায়িকা বলেন, " তিনি (দেবাঞ্জন) আমাকে বলেছিলেন, উনি রাজ্য সরকারের যুগ্মসচিব । নীল বাতি গাড়িতে নিয়ে ঘুরতেন, তাই তাঁর বক্তব্যে সন্দেহ হয়নি । উনি আমাদের অনুষ্ঠানে বেশ কিছু মাস্ক-স্যানিটাইজ়ার বিতরণ করেছিলেন । তখন তো জানতাম না যে উনি একজন প্রতারক । তাহলে নিশ্চয়ই তার থেকে আমরা সাহায্য নিতাম না । জনপ্রতিনিধিদের কাছে এমনভাবে অনেক আবেদন আসে । সবাইকে প্রতারক এমন তো নয় । তাই বোঝা সম্ভব হয়নি ৷"
অন্যদিকে বরানগরের বিধায়ক তাপস রায়কে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনিও বলেন, তিনি এমন কাউকে চেনেন না । এই বিষয়ে কোনও মন্তব্যও করতে চাননি । একইভাবে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম কলকাতা পৌরনিগমের মুখ্য প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম এবং রাসবিহারী কেন্দ্রের বিধায়ক দেবাশিস কুমারের সঙ্গে । দু'জনেই এই বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি ।
আরও পড়ুন : Fake Covid Vaccination : অস্তিত্বহীন ব্যক্তিদের নামে ভুয়ো অ্যাকাউন্টও খুলেছিল দেবাঞ্জন
এদিকে এই ঘটনায় রাজ্য সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী । তিনি জানিয়েছেন, ভুয়ো আইএএসের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা উচিত । বলেন, "কংগ্রেসের সিআইডির উপর যেমন ভরসা নেই, একইভাবে ভরসা নেই সিবিআইয়ের উপরও । তাই একজন বর্তমান বিচারপতিকে দিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করানোর দাবি জানাচ্ছি । রাজ্যের নেতা ও মন্ত্রীরা যেভাবে বয়ান দিচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে । আমরা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে হত্যার চেষ্টার মামলা দায়ের করার কথা বলছি । যেভাবেই হোক এদের করা শাস্তি দিতে হবে ৷"
এর পাশাপাশি আজ প্রাক্তন বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীও এই ঘটনার জন্য রাজ্যের শাসক দলকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন । তাঁর মতে, ভ্যাকসিন কাণ্ড যেভাবে হয়েছে সেটি খুব দুর্ভাগ্যজনক ৷ এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই । এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের মান-মর্যাদা শেষ করে দিল । শাসকদলের মদত ছাড়া দিনের পর দিন একটা এলাকায় ভ্যাকসিন ক্যাম্প করা অসম্ভব । ওই ব্যক্তি যে ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী তাতে কোন সন্দেহ নেই । তার সঙ্গে রাজ্যের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ... সবাইকে দেখা যাচ্ছে । তাঁদের সহযোগিতাতেই এই ব্যক্তি ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী হয়েছেন ।" তিনি আরও অভিযোগ করেন, "রাজ্যে টিকাকরণ কর্মসূচি শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় করতে গিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে । কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা পাচ্ছেন না । আবার কেউ একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে গিয়ে বিনা লাইনে টিকা দিয়ে চলে আসছেন । ভ্যাকসিন দেওয়াটাও এখানে দলতন্ত্রের উপর নির্ভর করছে । ফলে যে ঘটনা ঘটার তাই ঘটেছে ।"