কলকাতা, 30 অগাস্ট : বিচারক সিদ্ধার্থ কাঞ্জিলালের চেয়ার থেকে কয়েক ফুট দূরে বসেছিল শিশুটি । পরনে হলুদ টি শার্ট । উজ্জ্বল চোখে দেখছিল সবটা । মাঝেমধ্যে চলছিল "দিদি"-র ( রাজ়িয়া বিবির মেয়ে) সঙ্গে খুনসুটি । তারই মাঝে কখনও কখনও রেগে গিয়ে বসেছিল মায়ের কোলে । বয়স কত হবে? বড়জোর চার । না, তার বোঝার ক্ষমতা নেই কী চলছে আদালতকক্ষে । নিরাপত্তা কর্মীরা জানাচ্ছে, তবে আজ সে ছিল একটু বেশিই শান্ত ।
জন্মের পর থেকেই তার ঠিকানা জেলের অন্ধ কুঠুরি । বিচার ভবনের NIA বিশেষ আদালতের ঘরটাও তার কিছুটা চেনা । মায়ের হাত ধরে বারবার আসতে হয়েছে যে । বিচারকক্ষে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, সেই শিশুকে দেখিয়েই আলিমা বিবি বলেন, "হুজুর আমার একটা বাচ্চা আছে । ওকে মানুষ করতে চাই । সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে চাই । একটু বিবেচনা করবেন ।"
জেলে থাকাকালীন শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন আলিমা বিবি । খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সময় তিনি মাসখানেকের অন্তঃসত্ত্বা । বিচার চলাকালীন তৎকালীন বিচারক গোপালচন্দ্র কর্মকার আলিপুর মহিলা সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষকে আলিমার যথাযথ চিকিৎসার নির্দেশ দেন । তখন আলিমা চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা । কিছুদিন আগেই প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে আলিমার শওহর খাগড়াগড় বিস্ফোরণের আরও এক অভিযুক্ত আবদুল হাকিম । সে ওই বিস্ফোরণকাণ্ডে একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী । আজ আদালতকক্ষে দাঁড়িয়ে হাকিমের আবেদন ছিল একই । তিনি শেষবার কথা বলতে গিয়ে বিচারককে বলেন, "হুজুর, ছেলেকে মানুষ করতে চাই । বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা আছে, তাদের দেখভাল করতে চাই । সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে চাই ।"
2014 সালের 2 অক্টোবর । বর্ধমানের খাগড়াগড়ের একটি বাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে । বিস্ফোরণের ঠিক আগে শাকিল আহমেদ ও সুবহান শেখের সঙ্গে হাত মিলিয়েই হাকিম খাগড়াগড়ে হাসান চৌধুরির বাড়ির দোতলায় বসে IED তৈরি করছিল বলে অভিযোগ ওঠে । শাকিল এবং সুবহান ঘটনাস্থানেই মারা যায় । গুরুতর আহত হয় হাকিম । ঘটনার সময় ওই বাড়িতে ছিল দু'জন মহিলা, ছিল দুই শিশু । ঘটনার সময়ে বাড়ির মালিক আশরাফ আলি চৌধুরি পাশের নিজের বাড়িতেই স্নান করছিলেন । পাশাপাশি বাড়ি দুটো তাদেরই । বিস্ফোরণের শব্দ শুনে তিনি দোতলায় উঠে দেখেন, দরজায় ভিতর থেকে তালা দেওয়া । দুই মহিলা জানিয়ে দেয়, কিছুই হয়নি । ঘরে কোনও পুরুষ নেই । তাই দরজা খোলা যাবে না । সেই দুই মহিলা হল আলিমা বিবি ও রাজ়িয়া বিবি । 2 অক্টোবরের সেই বিস্ফোরণে অন্যতম দোষী হাকিমের হাঁটুতে মারাত্মক ক্ষতি হয় । তাকে SSKM -এ আনা হয় । সেখানে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা । সেই মতো 17 অক্টোবর তার প্রথম বার অস্ত্রোপচার হয় । কিন্তু তা সফল হয়নি । তাই পরে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার হয় । সরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে রোনাল্ড রস ভবনে প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের পাঁচতলায় ঘণ্টাখানেক ধরে অস্ত্রোপচার হয় । তারপর একটু একটু করে সুস্থ হয়ে ওঠে সে ।
আদালতের কাছে যে 19 জন দোষী আবেদন জানিয়েছিল তার মধ্যে ছিল এই দম্পতিও । আজ সব আবেদন শোনার পর সাজা ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারক সিদ্ধার্থ কাঞ্জিলাল বলেন, "যেহেতু আলিমার ছোট্ট শিশু রয়েছে । ও সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে চায়, তাই তার ছয় বছরের সাজা শোনানো হল । সঙ্গে 20 হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও 1 বছরের সাজা ।" তখন আলিমার কোলে বসে তার ছোট্ট শিশু । আলিমা গারদের দিকে তাকায় একবার । সেখানেই ছাই রঙা পাঞ্জাবিতে দাঁড়িয়েছিল আবদুল হাকিম । মুহূর্তে ডাক পড়ে তার । কাঠগড়ায় যায় হাকিম । বিচারক তার 8 বছরের সাজা শোনান । সঙ্গে 20 হাজার টাকা জরিমানা । অনাদায়ে আরও এক বছরের জেল । মুহূর্তে হাকিম তাকাল স্ত্রীর দিকে । একবার যেন চোখ গেল কোলের শিশুদিকেও । বিচারক তখন বলছেন, "মূলত অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং 125 IPC, সঙ্গে আন ল ফুল অ্যাক্টিভিটির জন্য এই সাজা দেওয়া হল ।"
আলিমার মুখ ছিল বোরখায় ঢাকা । তার অভিব্যক্তি দেখা যায়নি । কাঠগড়া থেকে নামার সময় হাকিমের দীর্ঘশ্বাস । হলুদ টি-শার্টে শিশুটি তখনও দিদির সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত ।