কলকাতা, 13 জুন : COVID-19 সংক্রমণের নিরিখে 11 জুন ভারতের স্থান বিশ্বে 4 নম্বরে পৌঁছে গিয়েছে । COVID-19-এ আক্রান্তের সংখ্যা এ রাজ্যেও বেড়ে চলেছে । এদিকে, গত বছর 11 জুনই NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শুরু হয়েছিল জুনিয়র ডাক্তারদের ঐতিহাসিক আন্দোলন । এই আন্দোলনের আগুন এ রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে কার্যত গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল । অবশেষে, গত বছর, 17 জুন নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের প্রতিনিধিদের বৈঠকের পরে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয় । নবান্নের ওই বৈঠকের জেরে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী । ওই সব প্রতিশ্রুতির কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে? এ রাজ্যের সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন কতটা হয়েছে? বিশ্বজুড়ে অতিমারী COVID-19-এর কারণে পরিস্থিতি এখন অন্যরকম । তবে, এই ধরনের পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার আগে পর্যন্ত ওই সব প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগ, প্রতিশ্রুতি হিসাবেই রয়ে গিয়েছে । পরিস্থিতি ঠিক যেমন ছিল, বর্তমানেও তেমনই আছে বলে যেমন জানিয়েছেন চিকিৎসকরা । তেমনই চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পরিকাঠামোগত খামতি থেকে গেছে । এই খামতির বিষয়টি COVID-19-এর এই সাম্প্রতিক পরিস্থিতিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় ৷
গত বছর 10 জুন বিকালে NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ট্যাংরার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলেন মৃত ওই রোগীর ক্ষুব্ধ পরিজনরা । ঘটনার জেরে ক্ষুব্ধ ওই পরিজনদের কাছে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আক্রান্ত হন বলে অভিযোগ ওঠে । এই ঘটনার জেরে ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে । মৃত ওই রোগীর ক্ষুব্ধ পরিজনরা ভিড় জমাতে থাকেন হাসপাতালে । পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসপাতালে পৌঁছে যায় বিশাল পুলিশবাহিনী । অভিযোগ, এরই মধ্যে গেটের বাইরে থেকে হাসপাতালের ভিতরে মৃত ওই রোগীর ক্ষুব্ধ পরিজনরা ইট ছুঁড়তে থাকেন । ওই ইটের আঘাতে মারাত্মকভাবে জখম হন এক জুনিয়র ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায় । তাঁর মাথায় আঘাত লাগে । তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মল্লিকবাজারে অবস্থিত বেসরকারি এক হাসপাতালে । এই ঘটনার জেরে আরও উত্তপ্ত হয়ে পরিস্থিতি । হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে কর্তব্যরত জুনিয়র ডাক্তাররা পৌঁছে যান ঘটনাস্থানে । তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, অবস্থান শুরু করেন, এই ঘটনার বিহিত চাইতে থাকেন । গত বছরের 10 জুন গভীর রাত (ঘড়ির কাঁটায় তখন অবশ্য 11 জুন) থেকে কর্মবিরতি শুরু করে দেন NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা । চলতে থাকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সির কাছে অবস্থান বিক্ষোভ । বিচার চাইতে থাকেন তাঁরা । দাবি জানানো হয় , মুখ্যমন্ত্রীকে ঘটনাস্থানে যেতে হবে । হাসপাতালের গেট আটকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করতে থাকেন । পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসনের তরফে চলতে থাকে চেষ্টা । হাসপাতালে যান স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য । পরের দিন 12 জুন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব ৷ বর্তমানে মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা । অভিযুক্ত 5 জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয় । তবে, এরপরেও দাবিতে অনড় থাকেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা । গত বছরের 10 জুন রাতে হাসপাতালে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে থাকে । অন্যদিকে, NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইমার্জেন্সির কাছে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান বিক্ষোভের মঞ্চে ভিড় বাড়তে থাকে । টানা চলতে থাকে অবস্থান । ব্যাহত হতে থাকে চিকিৎসা পরিষেবা । ছড়িয়ে পড়তে থাকে আন্দোলনের আগুন । NRS-এর এই দাবি আদায়ের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে একে একে কলকাতাসহ এরাজ্যের অন্য মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররাও শুরু করে দেন কর্মবিরতি । এ রাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের তরফেও সমর্থন জানানো হয় । জুনিয়র ডাক্তারদের সমর্থন জানিয়ে পাশে থাকার বার্তা দেন সিনিয়র ডাক্তাররাও । দিল্লির AIIMS - সহ দেশের অন্য বিভিন্ন স্থানের চিকিৎসকরাও NRS-এর আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে থাকেন । এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বহু বিশিষ্ট মানুষ NRS-এর অবস্থান বিক্ষোভের স্থানে বক্তব্য রাখেন । সমর্থন জানাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও বিক্ষোভের স্থানে যান । সমর্থন জানাতে থাকে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন । সরকারি, বেসরকারি চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ মঞ্চের তরফে রাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলির আউটডোরে 12 ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করা হয় । এই কর্মবিরতিতে অংশগ্রহণের জন্য সরকারি চিকিৎসকদের একাংশ গণছুটি নেয় । সাধারণ মানুষের বিভিন্ন অংশের সমর্থনও পেতে থাকে দাবি আদায়ের এই আন্দোলন । অন্যদিকে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে না ফিরলে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেন মুখ্যমন্ত্রী । ধর্মীয় পরিচয় দেখে চিকিৎসকরা চিকিৎসা পরিষেবা দেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি । যার জেরে দেখা দেয় বিতর্ক । তবে, দাবিতে অনড় থাকেন আন্দোলনরতরা । চিকিৎসকদের মহামিছিলে সরকারি-বেসরকারি, সিনিয়র-জুনিয়র ডাক্তারদের পাশাপাশি বিশিষ্ট অনেক মানুষও যেমন পা মেলান । অবশেষে, গত বছরের 17 জুন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আন্দোলনরত চিকিৎসকদের প্রতিনিধি হিসাবে 31 জন জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে নবান্নে বৈঠকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী । সরকার প্রথমে রাজি না হলেও, পরে আন্দোলনরতদের দাবি অনুযায়ী সংবাদমাধ্যমে এই বৈঠকের লাইভ সম্প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ।
কী হল এরপর ?
রাজ্যের সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস ৷ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক মানস গুমটা বলেন, " দুই-চারটি হেলপ্লাইন তৈরি করা, পুলিশের কে, কোন জ়োনে থাকবেন, তা জানিয়ে দেওয়া । দুই-চারটি হাসপাতালে দুই-চারটি হোর্ডিং লাগানো । সবই সাময়িক ছিল । " প্রতিটি হাসপাতালে পুলিশ ফাঁড়ি, অভিযুক্তকে নন বেল-এবেল ধারায় গ্রেপ্তার করাসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল । একথা জানিয়ে তিনি বলেন, " তার মধ্যে দুই-একটি ফোন নম্বর সরকারিভাবে ঘোষণা করা ছাড়া আর কিছু বাস্তবায়ন হয়নি । পরিস্থিতি ঠিক যেমন ছিল, বর্তমানেও তেমনই আছে । " তিনি আরও বলেন, " মাঝে মধ্যে সরকারকে আমরা জানিয়েছি, যে প্রতিশ্রুতিগুলি দেওয়া হয়েছিল সেগুলি রূপায়িত হোক । কিন্তু দুই-চারটি ছোটখাটো বিষয় ছাড়া বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি, প্রতিশ্রুতি হিসাবেই রয়ে গেছে । NRS-এর পরেও চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা হয়েছে । COVID-19-এর এই পরিস্থিতি কেটে গেলে জানি না আবার একই রকমভাবে নিগ্রহের সম্মুখীন হতে হবে কি না । COVID-19-এর আবহে হয়ত চিকিৎসক নিগ্রহের পরিমাণ কমেছে । কিন্তু, চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের যে আচরণ, এখনও তা দেখা যাচ্ছে COVID-19 সংক্রমিত হলে বা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরলে । চিকিৎসকদের সম্মান জানানোর জন্য হাততালি, ফুল ছোঁড়া এসব অনেক কিছুই হয়েছে । এরপরে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে , চিকিৎসকদের সুরক্ষা চিকিৎসকদের নিজেদেরই নিতে হবে । মানে, সৈন্যবাহিনীকে আপনি যুদ্ধ করতে পাঠাবেন, আর তাঁর সুরক্ষার দায়িত্ব নেবেন সৈন্যরাই । এটা হচ্ছে রাষ্ট্রের মতামত । একই রকমভাবে আমাদের এখানেও তাই হচ্ছে । COVID-19-এর আবহে যতটা সুরক্ষা পাওয়ার কথা, সব সময় যে চিকিৎসকরা পাচ্ছেন, তা নয় । "
চিকিৎসকদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের সভাপতি, চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত বলেন, " NRS-এ এর আগে এরকম আক্রমণ আমরা দেখিনি । আক্রান্ত হয়েছিলেন পরিবহ মুখোপাধ্যায় । আমরা দেখেছিলাম, হয়তো বহুদিনের জমা ক্ষোভ ফেটে পড়েছিল । চিকিৎসকদের মধ্যে আমরা অদ্ভুত এক ইউনিটি দেখেছিলাম ৷ যেটা কি না কেউ কোনও দিন জ্ঞানত, জীবিত কোনও ডাক্তার দেখেছেন বলে মনে পড়ে না । সিনিয়র-জুনিয়র, সরকারি-বেসরকারি সব রকম চিকিৎসকদের ইউনিটি দেখেছিলাম । আগুনটা দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম । সাধারণ মানুষ দলে দলে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন । ঐতিহাসিক একটি মিছিল হয়েছিল । আমাদের আত্মীয়-পরিজনরাও রাস্তায় নেমেছিলেন । 15-20 সব বয়সী মানুষ আমাদের সঙ্গে হেঁটেছিলেন । এটা অভূতপূর্ব । "
কিন্তু এর পরে...?