কলকাতা, 15 অগস্ট: বিবেকানন্দ রোড ও বিধান সরণীর সংযোগস্থলের বাঁদিকের কোনাকুনি অবস্থানে রয়েছে ডি এম লাইব্রেরি । ছাপোষা দেখতে এই দোকানের অন্দরমহলে লুকিয়ে আছে স্বাধীনতা আন্দোলনের না বলা কথা । ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির সারি, ফুটপাতে মানুষের পথচলার ফাঁকে ডি এম লাইব্রেরির অব্যক্ত ইতিহাস শহর কলকাতার চোখে পড়ে না । অথচ স্বাধীনতার 75 বছর পূর্তিতে উত্তর কলকাতার এই শতাব্দী প্রাচীন বইয়ের দোকান নিজেই এখন ঐতিহাসিক দলিল(75 years of independence day DM library still exists in pride with the history of independence)।
শুরুর সেদিন :
বাঘাযতীনের মৃত্যুর পরে কলকাতা জুড়ে তখন ব্রিটিশ পুলিশের ধরপাকড় শুরু হয়েছে । অন্য অনেকের মতই গা ঢাকা দিলেন গোপাল দাস মজুমদার । বেশ কয়েকবছর ফেরার থাকার পর তিনি কলকাতায় ফেরেন । কিন্তু ফেরার পরেও অন্ন সংস্থান এবং কাজের জোগাড় হচ্ছিল না । বিপদের দিনে সাময়িক সাহায্যের হাত বাড়ালেন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা । তাঁদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতে হত । এদিকে দীপান্তরের সাজা কাটিয়ে কলকাতায় ফিরেছেন বারীন্দ্র ঘোষ । অরবিন্দ ঘোষ তখন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে চন্দননগর হয়ে পণ্ডিচেরী চলে গিয়েছেন । এই অবস্থায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পৃষ্ঠপোষকতায় বারিন ঘোষরা খুললেন বিজলী পত্রিকা । তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গোপাল মজুমদার সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করলেন । সেখানে ম্যানেজার ছিলেন বিধুভূষণ দে । তাঁদের দু'জনের পদবীর ইংরাজী বানান মজুমদারের অদ্যাক্ষর এম এবং দে পদবীর ইংরাজী বানানের আদ্যক্ষর ডি নিয়ে তৈরি হল ডি এম লাইব্রেরী । সেই সময় বইয়ের দোকানের নাম বোঝাতে লাইব্রেরী শব্দটি ব্যবহার হত । প্রথমে ডি এম লাইব্রেরি পুস্তক বিক্রেতা হিসেবে কাজ শুরু করেছিল । সেই সময় সাইকেলে করে বিজলী পত্রিকার ডিস্ট্রিবিউশনের সময় গোপাল এবং বিধুবাবু বই বিক্রির কাজটা করতেন । এভাবে দু'বছর চলার পরে প্রকাশনায় আসার পরিকল্পনা করা হয় । প্রথম ছাপানো বই হিসেবে বিজলী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বারিন ঘোষের আত্মকথাকে বেছে নেওয়া হয় । এই ব্যাপারে অনুমতি নেওয়া হয় । চলতি বছরটি সেই আত্মকথা প্রকাশেরও শতবর্ষ ।
ডি এম লাইব্রেরিতে ফিরে দেখা ইতিহাসের কিছু ঝলক আরও পড়ুন :বিদ্রোহের লেখা থেকে স্বাদেশিকতার সুর, পরাধীন ভারতে আগুন ঝরেছিল যাঁদের কলমে
অরবিন্দ ঘোষ এবং বারিন ঘোষের আশীর্বাদ :
প্রথম থেকেই বিজলী পত্রিকার কর্মকাণ্ডের উপর নজর ছিল ব্রিটিশ পুলিশের । একদিন এই পত্রিকার দফতরে ভাঙচুর চালালো তাঁরা । এরপর দাদা অরবিন্দ ঘোষের মত বারিন ঘোষও পণ্ডিচেরী চলে গিয়েছিলেন । কিছু বছর সেখানে থেকে ফের কলকাতায় আসেন । তারপর যোগাযোগ হয় গোপালবাবুর সঙ্গে । এই বিষয়ে ডি এম লাইব্রেরীর বর্তমান কর্ণধার আশিস গোপাল মজুমদারের কথায়, তিনি বারিন ঘোষকে দেখেননি । শুনেছেন শেষ জীবনে অথর্ব হয়ে পড়েছিলেন বারিনবাবু । তবে বিজলীর প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ডি এম লাইব্রেরীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর । ভাইয়ের মত দাদা অরবিন্দ ঘোষও ডি এম লাইব্রেরীর কাজের সমর্থক ছিলেন । যদিও তাঁর লেখা সমস্ত বই ছাপত আর্য পাবলিকেশন । অন্যান্য বই ছাপানোর পাশাপাশি কবি নজরুল ইসলামের বইও ছাপাতে থাকে । এই ব্যাপারটি জানার পরে অরবিন্দ ঘোষ আপত্তি জানান । বলেন অন্যের বই ছাপালে তিনি আর সঙ্গে থাকবেন না । পুস্তক বিক্রির যে স্বত্ব দেওয়া হয়েছে তা তুলে নেবেন । এরপর নজরুলের বই ছাপানোর দায়িত্ব ছেড়ে দেয় আর্য পাবলিকেশন ।
বিদ্রোহী কবির সঙ্গে গাঁটছড়া :
হঠাৎ করে পাবলিকেশন হাউজ বই প্রকাশনার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ায় বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম সমস্যায় পড়ে যান । এই সময় তিনি গোপাল মজুমদারের কাছে গিয়ে বলেন, রাস্তায় দু'জনকেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছে । মরি বাঁচি একসঙ্গে যা হওয়ার হবে । যদিও কবির এই প্রস্তাবে প্রথমে রাজি হননি গোপালবাবু । কারণ অনিশ্চয়তার মধ্যে সংসারী বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে আসাতে আপত্তি ছিল তাঁর । নজরুল ইসলাম আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দেখে কল্লোল গোষ্ঠীর সব লেখকরা ডি এম লাইব্রেরিতে চলে আসেন । এরপর দিকপাল লেখকদের কবিতা উপন্যাস এখান থেকেই ছাপা হয় । কল্লোল গোষ্ঠীতে নজরুল লিখতেন । ফলে সেখানকার কবি লেখকরা চলে এলেন । শনিবারের চিঠি এখান থেকে ছাপা শুরু হয় । কল্লোল এবং শনিবারের চিঠি দুটো ভিন্ন ধরনের বিষয় হলেও এক জায়গা থেকে বেরিয়েছে । আবার শুভ ঠাকুরের লেখা ফিউচারিস্ট থেকে বেরোত । অসাধারণ সে ছাপা । তিনিও এখানে আসতেন ৷
আরও পড়ুন :দেশ বদলে দিয়েছিল যে সব সিদ্ধান্ত, স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তীতে ফিরে দেখা একনজরে
বিষের বাঁশি এবং পুলিশি ধরপাকড় :
এরপর নজরুলের লেখা একে একে অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি রাজরোষে পড়ে যায় । নজরুল ইসলাম যাদের এই বই দু'টির খসড়া পড়িয়েছিলেন তাঁরাও প্রমাদ গুনলেন । আশঙ্কা সত্যি হল । প্রকাশিত হতেই বিষের বাঁশি ব্রিটিশ পুলিশের বিষ নজরে পড়ে। ধরপাকড় শুরু হয় । ডি এম লাইব্রেরির সোল সেলিং এজেন্ট, প্রকাশক তখন নজরুল ইসলাম । এমনিতেই ডি এম লাইব্রেরীতে বিপ্লবীদের আনাগোনার কারণে পুলিশি নজর ছিল । বিষের বাঁশি প্রকাশ হতেই হানা দিল পুলিশ । 2 হাজার 200 বই ছাপা হয়েছিল । কিন্তু সেগুলি বাঁধানো না হওয়ায় সব বই ছিল না ডি এম লাইব্রেরিতে । কিছু ছিল কাগজ দিয়ে ঢাকা । ব্রিটিশ পুলিশ হাতের কাছে যা পেল নিয়ে চলে গেল । বাকি যা ছিল চোখের আড়ালে রয়ে গেল । পুলিশের হঠকারিতায় সেদিন বেঁচে গিয়েছিল বিষের বাঁশি ।
নতুন প্রজন্ম এবং স্বাধীনতার উত্তরাধিকার :
প্রাচীন গ্রিসে দেশের চিন্তাবিদরা জিমনাসিয়ামে আলোচনায় ব্যস্ত হতেন । সেখানে শরীরচর্চা নয় হত বুদ্ধি এবং মতের চর্চা । ডি এম লাইব্রেরী ছিল স্বাধীনতা পূর্ববর্তী আমলের সেই জিমনাসিয়াম । যেখানে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সেনানি, লেখক ও কবিরা তাঁদের মতের আদানপ্রদান করতেন পরিকল্পনা সাজাতেন । ফলে ডি এম লাইব্রেরী শুধু বই প্রকাশক বিক্রেতা নয় । এক স্বাধীনতা যুদ্ধের নীল নকশার আঁতুড়ঘর । 75তম স্বাধীনতা দিবস পালনের অন্যতম তীর্থক্ষেত্রও বটে ।
আরও পড়ুন :স্বাধীন ভারতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন এবং সুপ্রিম রায়