জলপাইগুড়ি, 27 ফেব্রুয়ারি : "সরকারি সুযোগ সুবিধার মুখ সবে দেখতে শুরু করেছি ৷ ইদানিং রাস্তা-ঘাট হচ্ছে ৷ সবাই জানে আমরা ভারতের নাগরিক ৷ অথচ এদেশের ম্যাপে আজও আমাদের গ্রামের জমিগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়নি ৷"
"ওই জমিটা দেখতে পাচ্ছেন ? ওটা আমার ৷ ওখানেই আমি ফসল ফলাই ৷ সারাবছর খাটি ৷ কিন্তু, ওই জমি বিক্রির অধিকার আমার নেই ৷ বাড়িতে সুবিধে-অসুবিধে রয়েছে ৷ বিক্রি করার প্রয়োজন পড়ে বইকি মাঝে মাঝে ৷ কিন্তু, পারি না ৷ দেশে থেকেও সব সুযোগ সুবিধে পাচ্ছি না ৷"
জলপাইগুড়ি সদর ব্লক লাগোয়া ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বেরুবাড়ি এলাকা ৷ প্রথম বক্তা দেবব্রত রায় প্রধান ৷ দ্বিতীয়জন সত্যেন রায় প্রধান ৷ দু'জনেই জানালেন এই সমস্যা শুধু তাঁদের নয় ৷ কয়েক দশক ধরে একই সমস্যায় ভুগছে দক্ষিণ বেরুবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতরী দেবোত্তর, কাজলদিঘি ও পরাণিগ্রাম গ্রাম ৷ জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের তরফে জানা গেছে, এই গ্রামগুলি আসলে অ্যাডভার্স পোজ়েশনের মধ্যে ছিল ৷ এখনও জমি জরিপের কাজ চলছে ৷ ফলে জমিগুলির মালিকরা হাতে কাগজপত্র পাননি ৷ জরিপ ও দুই দেশের মাঝে কাঁটাতার দেওয়ার কাজ শেষ হওয়ার পরই গ্রামের জমিগুলিকে ভারতের ম্যাপে আনা হবে ৷ তখন জমি বিক্রির অধিকারও পাবেন মালিকরা ৷ একই তথ্য দিলেন জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের প্রাক্তন বিধায়ক গোবিন্দ রায় ৷ জানালেন, জমি জরিপ ও দুই দেশের মাঝে কাঁটাতার দেওয়ার কাজ শেষ না হলে অ্যাডভার্স পোজ়েশনের তকমা মুছবে না এই এলাকাগুলির ৷
কেন এই সমস্যা ? এর পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস ৷ 1947 সালে দেশ ভাগের পর বেরুবাড়ি কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নিয়ে সমস্যা দানা বাঁধে ৷ 1958 সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ ও ছিটমহল সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৷ চুক্তিতে ঠিক হয়, দক্ষিণ বেরুবাড়ির অর্ধেক অংশ পাকিস্তানকে দেওয়া হবে ৷ ফলে দক্ষিণ বেরুবাড়ির একটি নির্দিষ্ট অংশ তৎকালীন পাকিস্তানে চলে যায় । কিন্তু, নিজেদের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়নি বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ ভারতেই থাকার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে তারা ৷ 1961 সালের 26 জানুয়ারি বেরুবাড়ির বাসিন্দারা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা প্রাণ থাকতে পাকিস্তানে যাবে না ৷ "রক্ত দেব প্রাণ দেব, বেরুবাড়ি ছাড়ব না", এই শ্লোগানকে হাতিয়ার করে চলতে থাকে আন্দোলন ৷ 1971 সালে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে বাংলাদেশ নামে এক আলাদা রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে ৷ প্রধানমন্ত্রী হন শেখ মুজিবর রহমান ৷ এবারে পরিস্থিতি ফের বদলায় ৷ 1974 সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে তিনবিঘা করিডোর চুক্তি হয় ৷ সেই চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ বেরুবাড়ির যে অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল তা ভারতকে হস্তান্তর করা হবে ৷ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে দক্ষিণ বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ বেরুবাড়ি আন্দোলনের ফলেই ভারতে থাকার অধিকার পেল বলে মনে করতে থাকে তারা ৷
তবে এবার এক নতুন সমস্যা দেখা দেয় ৷ 1974-এর চুক্তি বেরুবাড়ির নির্দিষ্ট অংশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করলেও জমি জরিপ ও সীমানা নির্ধারণের সময় সমস্যা তৈরি হয় ৷ দেখা যায়, ওই এলাকায় ভারতের এমন কিছু জমি আছে যেখানে বাংলাদেশের মানুষ বসবাস করছে আবার বাংলাদেশের কিছু জমিতে ভারতের লোকও বসে রয়েছে ৷ সেই জায়গাগুলিকে অ্যাডভার্স পোজ়েশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৷ এরকমই জায়গা হল এই চিলাহাটি, বড়শশী, নাওতরী দেবোত্তর, কাজলদিঘি ও পরাণিগ্রাম গ্রাম ৷ ফলে ওই এলাকার জমির জরিপ ও সীমান্ত নির্ধারণ না হওয়ায় ভারতের মানচিত্রে এলাকাগুলিকে জায়গা দেওয়া হয়নি ৷ ফলে ভারতে থাকার আন্দোলন শেষ হতে না হতেই আবারও সমস্যায় পড়ে বেরুবাড়ির বাসিন্দারা ৷ অ্যাডভার্স পোজ়েশন মধ্যে থাকায় বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে তারা ৷ প্রশাসনের তরফে বেরুবাড়ির মানুষকে আশ্বাস দেওয়া হয়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এই সমস্যার সমাধান হবে ৷
2015 সাল ৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৷ নির্ধারিত সীমায় কাঁটাতার দেওয়ার কাজ শুরু হয় ৷ বেরুবাড়ির অ্যাডভার্স পোজ়েশনে কাজ শুরু করে প্রশাসন ৷ জমি জরিপ ও কাঁটাতার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয় ৷ তবে ওই এলাকার মানুষের অভিযোগ, উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজ চলছে ধীর গতিতে ৷ কবে শেষ হবে বোঝা যাচ্ছে না ৷