নিউ ইয়র্ক, 13 এপ্রিল : অ্যামেরিকায় কর্মসূত্রে আমি রয়েছি দীর্ঘ 35 বছর ধর । একটা দেশকে চেনার জন্য সময়টা খুব একটা কম নয় । আমি কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ার তথা স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্কের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর । যেহেতু আমি এখানে পড়াই সেহেতু এই দীর্ঘ সময়ে বহু ধরনের মানুষকে দেখেছি । অ্যামেরিকাকে চিনেছি । কিন্তু বিশ্বাস করুন এই দেশকে শেষ 35 বছরে কখনও এমন নিষ্প্রাণ হতে দেখিনি । অ্যামেরিকা বরাবরই প্রাণবন্ত একটা রাষ্ট্র । কিন্তু দিন যত যাচ্ছে ততই যেন ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে আশপাশটা । হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণবন্ত ভাবটা । কয়েকমাস আগেও কর্মক্ষেত্র যাওয়ার সময় রাস্তায় কত মানুষ থাকত ৷ কিন্ত 35 বছরের চেনা রাস্তা আজ যেন কেমন অচেনা লাগে ৷
এখন শুধু রাস্তার দুই পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক গাড়ি ৷ আমি আর আমার স্ত্রী সোনালি অ্যামেরিকার নিয় ইয়র্ক প্রদেশের সিরাকিউস শহরে থাকি ৷ এই শহর থেকে নিউ ইয়র্ক যেতে গাড়িতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা ৷ আমরা যেখানে থাকি, সেই জায়গার নাম ফরেস্ট হিল ড্রাইভ ৷ আমার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে প্রায় চার মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্বেই হান্টিংটন প্রি কে 8 স্কুল ৷ একটি সময় এই জায়গায় রোজ স্কুলের সময়ে কচিকাঁচাদের ভিড় হত ৷ কিন্তু গত একমাস ধরে স্কুলের সামনের নিস্তব্ধতা ৷ পরিবেশটা জানান দিচ্ছে যে স্কুল বন্ধ ৷ কোনও একটা অজানা আতঙ্ক যেন সারা শহরকে গ্রাস করেছে৷
প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য "ইন্ডিয়ান স্টোর" এতক্ষণ ধরে একটানা কথা বলে একটু থামলেন সিদ্ধার্থবাবু ৷ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ৷ বাঁ দিকে থাকা কম্পিউটাটার দিকে তাকিয়ে ফের বলতে শুরু করলেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা । ভারতের মতো এখানেও লকডাউন চলছে । একটা সময় শহরের রাস্তায় প্রত্যেকদিন হাজারো গাড়ি গন্তব্যে ছুটে যেত ৷ কিন্তু আজ সেই রাস্তাগুলো খাঁ খাঁ করছে । শহরের প্রশাসনের তরফে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কেনাকাটি ছাড়া অন্য কোনও কাজে আমরা জন্য বাড়ির বাইরে না বেরোই । একমাত্র জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদেরকে ছাড়ের আওতায় রাখা হয়েছে ।
অজানা আতঙ্ক যেন সারা শহরকে গ্রাস করেছে কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে? অ্যামেরিকাকে কি আগের মত প্রাণবন্ত দেখতে পাব? জানি না । তবে প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে সংক্রমণ ছড়ানোর গতি কিছুটা ধীরে হয়েছে । এ খবর আশার আলো দেখাচ্ছে আমাদের । আপনারা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছেন স্পেনকে ছাড়িয়ে গিয়েছে অ্যামেরিকা । লাফিয়ে লাফিয়ে শেষ কয়েকদিনে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা । তবে সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয়টা হল, দেশের অর্থনীতির কী হবে? সেইসঙ্গে চাকরির অবস্থা ও এই দেশে বড় ধাক্কার মুখে পড়তে চলেছে তা বেশ বুঝতে পারছি । একটু বিস্তারিত বলার চেষ্টা করছি ।
কোরোনা আতঙ্কে খালি দোকান-পাট আসলে এই দেশে 70 শতাংশের কাছাকাছি মানুষ অস্থায়ী কাজ করেন । অর্থাৎ ভারতে আমরা যেমন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ বুঝি ঠিক তেমনি । এটাই এখানকার সংস্কৃতি । ফলে সেভিংস জিনিসটা এই দেশে কারও সেরকম নেই । এতটুকু বলাই যায় 60 শতাংশ মানুষের গড় সঞ্চয় 400 ডলার কিংবা তারও কম । ভারতীয় টাকায় যা দাঁড়ায় ওই 30 হাজারের কাছাকাছি বা তাঁর থেকে একটু বেশি ৷ তাই আগামী দিনে এখানের মানুষ যে বড়সড় বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে, তা চোখ বন্ধ করেই বলা যায় । পাশাপাশি আরও একটা তথ্য ও আপনাদের জানাতে চাইব । ইতিমধ্যেই 10 মিলিয়ন মানুষ গত সপ্তাহে 'আন-এমপ্লয়েড' হিসেবে রেজিস্টার্ড হয়েছে । ফলে তাঁদের জন্য আগামী দিনে কী ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে তা বলা যাচ্ছে না ।
নিউ ইয়র্কের বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক কেমন? এই পরিস্থিতিতে নিজেদের ব্যক্তিগত দিনযাপন কেমন কাটছে তা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, হপকিন্স সাইটের থেকে জানতে পারলাম 20 হাজার 602 মৃতের সংখ্যা । গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল আমার। কারণ সংখ্যাটা মোটেও কম নয় । ভয়টা একলাফে কয়েকগুণ বেড়ে গেল যখন দেখলাম আমি যেখানে থাকি অর্থাৎ নিউ ইয়র্কেই প্রাণ হারিয়েছে ছয় হাজারের বেশি মানুষ । এরইমধ্যেই কিভাবে আছি সেটা হয়তো বলে বোঝানো যাবে না । নতুন করে বলার কিছু নেই । গৃহবন্দী আছি দীর্ঘদিন ধরেই । স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি সবই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । অন্যান্য বছর এই গরমের সময়টা আমি চিনে যাই পড়াতে । কিন্তু এবছর তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে । ফলে আমার পড়ানো পুরোটাই অনলাইনে করাতে হচ্ছে । জানি না এভাবে কতদিন কাটবে । একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোন জায়গাতেই যাচ্ছি না । যে সমস্ত জায়গা থেকে আমরা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনি অর্থাৎ, 'ইন্ডিয়ান স্টোর', সেখানেও নিরাপত্তার কারণে সাত জনের বেশি একসঙ্গে যেতে দেওয়া হচ্ছে না । সেইসঙ্গে গ্লাভস-মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে । এই পরিস্থিতিতে দেশে ফিরতে ইচ্ছে হয় না প্রশ্ন করলে তিনি জানান, বর্তমানে সমস্ত গণপরিবহণ বন্ধ, তাই দেশে ফেরার বিষয়টা নিয়ে ভাবতে পারছেন না ৷