হাওড়া, 10 এপ্রিল : হাওড়ার আন্দুল এলাকায় রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটলেই কানে আসে খট, খট, ঘটাং শব্দ । শব্দের উৎস কাঠের ও সীসার ব্লকে চলা প্রিন্টিং প্রেস । আর এই প্রেসগুলোতেই অতীত কাল থেকে ছেপে বেরতো বাংলা নববর্ষের ক্যালেন্ডার (Low demand of Bengali calendar)। বাঙালির কাছে বাংলা নববর্ষ মানেই হালখাতা, দোকানে দোকানে ক্রেতাদের মিষ্টির প্যাকেট আর বাংলা ক্যালেন্ডার বিলি । এইবার অবশ্য ক্যালেন্ডারের চাহিদা কম । ক’দিন বাদেই পয়লা বৈশাখ । অথচ ক্যালেন্ডার যাঁরা বানান, তাঁদের কাছে বাংলা ক্যালেন্ডার (Bengali new year) তৈরির তেমন বরাতই আসেনি ।
হাওড়ার (Howrah news) আন্দুল এলাকায় সত্তর বছরের পৈতৃক ব্যবসা শ্রীকুমার কুণ্ডু চৌধুরীদের । তিনি নিজেও চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে ক্যালেন্ডার তৈরির কারবারে যুক্ত হয়েছেন । তিনি বলেছেন, বাংলা হরফের চেয়ে ইংরেজি হরফের প্রচলন অনেক বেশি । বাংলা নববর্ষের আগে চাহিদা থাকলেও সারা বছর সেভাবে থাকে না । এত দিন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গার ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির বরাত দিতেন । তবে এ বছর বরাত কমেছে বলেই জানান তিনি ।
কোভিডের জন্য এ বছরে বরাত কমলেও সামনের বছরে তা পুষিয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি । তবে তাঁর দাবি, ক্যালেন্ডারের চাহিদা কখনওই কমবে না । কারণ বাড়িতে বয়স্ক লোকেদের বাংলা ক্যালেন্ডার চাই-ই চাই । তাই আগে একান্নবর্তী পরিবার হওয়াতে লোকে তিনটে চারটে করে ক্যালেন্ডার নিয়ে যেত । তবে এখন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ফ্ল্যাট কালচার এসেছে । দেওয়ালে পেরেক মেরে ক্যালেন্ডার ঝোলাতে তাই দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছে মানুষ । তবে বাড়ির বয়স্ক মহিলাদের ঠাকুরঘরে বাংলা ক্যালেন্ডার ছাড়া চলবেই না বলে দাবি তাঁর ।
আরও পড়ুন: Night Curfew Relaxation in Bengal : বড়দিন ও নববর্ষ উপলক্ষে রাজ্যে নাইট কার্ফু শিথিল, খুশি রেস্তোঁরা ব্যবসায়ীরা
পাশাপাশি তাঁর আক্ষেপ, তিনি চোখ বুজলে তাঁর এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে । তাঁর পরের প্রজন্ম এই ব্যবসাতে আগ্রহী নয় । তাঁর ষাটের উপরে বয়স হয়েছে, তাই আর অফসেট প্রিন্টিংয়ের পথে হাঁটেননি তিনি । যদিও কারখানাতে কম্পোজার অসিত দাস জানান, এই লাইনের অবস্থা এখন খুবই খারাপ । ডিজিটাল অফসেট মেশিন বাজারে চলে আসার পরে চাহিদা তলানিতে এসে ঠেকেছে । অনেক ব্যবসায়ী কোভিডের আগে প্রতি বছর ক্যালেন্ডারের অর্ডার দিত । কোভিডের পরে তারাও এক বছর দু বছর ধরে অর্ডার দিচ্ছে না । তাই সারা মাস ধরে একটানা কাজও থাকে না বলে জানালেন তিনি ।
এই কারখানাতে মেশিনে টাইপ কম্পোজ করেন স্বপন জানা । তিনি বলেন, আগে কাঠের, সীসার টাইপ ব্যবহৃত হত । এখন সে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে । এখন হাতে যে সীসার ব্লক তৈরি করা আছে, তাই দিয়েই কোনওরকমে কাজ চালাচ্ছেন । সেগুলো নষ্ট হয়ে গেলে কাজও বন্ধ হয়ে যাবে বলে দাবি তাঁর । নতুন প্রজন্মের কেউ আর এই কাজে আসছে না বলে জানালেন তিনি । একেকটা বাংলা অক্ষর বসিয়ে ব্লক তৈরি করার ধৈর্য্য নেই এখনকার প্রজন্মের । তাই এখন বাজারে ছেয়ে গিয়েছে অফসেট ও ডিজিটাল মেশিনে । তিনি দাবি করেন, রাজ্যে চিটফান্ডের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাংলা ক্যালেন্ডার-সহ ইংরাজি ক্যালেন্ডারেরও চাহিদা অনেক কমে গিয়েছে । চিটফান্ডের এজেন্টরা তাঁদের গ্রাহকদের জন্য বেশি সংখ্যায় ক্যালেন্ডারের বরাত দিতেন । এখন তাঁরাও নেই, তাই সেই বরাতও নেই ।
আরও পড়ুন:Covid-19 Protocol: বড়দিন ও নববর্ষেও মানতে হবে করোনাবিধি, নতুন করে নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের
তবে একদা ইংল্যান্ডের শেফিল্ড তকমা পেয়েছিল হাওড়া । যত দিন গিয়েছে ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে একের পর এক ছোট কারখানার । এখন হাতে গোনা একটি দুটি কারখানাতে ক্যালেন্ডার ছাপার কাজ চললেও অদূর ভবিষ্যতে তাও কালের গর্ভে বিলীন হতে চলেছে বলে মনে করেন হাওড়ার ক্যালেন্ডার ব্যবসায়ীরা ।