চুঁচুড়া , 5 সেপ্টেম্বর : রাস্তার ধারে দীর্ঘ লাইন । কোথাও আবার জটলা । চলছে বস্ত্র বিতরণ । কোথাও আবার রান্না করা খাবার তুলে দেওয়া হচ্ছে । শুধু তাই নয়, সবজি থেকে শুরু করে ওষুধ, মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, বই-খাতা কী নেই ! সবটাই বিনা পয়সায় । উদ্যোক্তা চুঁচুড়ার সাহাগঞ্জ শ্যামাপ্রসাদ জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুজিত দাস । নাম দিয়েছেন বিনা পয়সার বাজার । একটাই বার্তা সেখানে । দু'-হাত বাড়াও । অর্থাৎ এক হাত দিয়ে সাহায্য করা, আর এক হাতে সাহায্য তুলে দেওয়ার বার্তা । দুস্থ ও গরিবদের কথা ভেবেই তাঁর এই উদ্যোগ ।
প্রথমটা শুরু করেছিলেন চুঁচুড়ার খরুয়া বাজার দয়াময়ী কালীবাড়ি গলির নিজের দোকান থেকে । তিনি সাহাগঞ্জ শ্যামাপ্রসাদ জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক । 2010 সালে শিক্ষক হওয়ার পর গার্মেন্টসের দোকান বন্ধ করে বিনা পয়সার দোকান খোলার কথা ভাবেন । সেই অনুযায়ী , তাঁর বন্ধু-বান্ধব থেকে সকলের সঙ্গে আলোচনা করেন । এই মহৎ চিন্তাভাবনাকে স্বাগত জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর শুভাকাঙ্খীরা । এরপর 2019 সালে সেপ্টেম্বর মাস থেকে পথ চলা শুরু হয় তাঁর ।
দুস্থ ছাত্রদের বই-খাতা ও গরিবদের জামাকাপড় দিয়ে সূচনা হলেও, তা এখন আরও বড় আকার নিয়েছে । যেসব জায়গায় মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন সেইসব প্রত্যন্ত জায়গায় পৌঁছে গেছেন তাঁরা । বিভিন্ন জায়গায় হাট বসিয়েছেন । সেখানে জামা-কাপড় , বই-খাতা দেওয়ার পাশাপাশি সবজি , ওষুধ , নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিনা পয়সায় বিতরণ করেছেন । শুধু বিনা পয়সা নয় । নিজের পছন্দ অনুযায়ী জামা-কাপড় বাছাই করে নিতে পারেন তাঁরা । কোরোনা পরিস্থিতির আগে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য বই ছাড়াও গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থাও করেছেন তাঁরা । জানুয়ারি মাসে 62 জন ছাত্র-ছাত্রীকে বই, খাতা পড়াশোনার সামগ্রী দিয়েছেন । লকডাউনেও থেমে থাকেনি তাঁদের কাজ । প্রকৃত দুস্থ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন । নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে ওষুধ সব কিছু দুস্থদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন । এমনকী , আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনে বেশ কয়েকবার ত্রাণ দিয়ে এসেছেন । জিনিসপত্র দেওয়ার জন্য পুরুলিয়া গেছেন । চুঁচুড়া , চন্দননগর-সহ বেশ কিছু জায়গায় এখনও প্রায় 127 টি পরিবারের জন্য খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন ।
সুজিতবাবু বলেন , " চাকরি পাওয়ার আগে একমাত্র রুটি-রুজির জায়গা ছিল আমার দোকান । চাকরি পাওয়ার পর দোকান বন্ধ হয়ে যায় । এরপর একটি চিন্তা আমার মাথায় আসে । যাতে দোকানও আর বন্ধ হয়ে পড়ে না থাকে , আবার সমাজের জন্য়ও কিছু করতে পারি । যে সময়টা আমরা গল্প করে , আড্ডা দিয়ে নষ্ট করি । সেই সময়টুকু মানুষের জন্য যাতে কাজ করতে পারি , তা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলি । এখন বেশিরভাগ পরিবার ছোটো । অনেকের বাড়িতে নতুন - পুরানো প্রচুর পোশাক পরে থাকে । কিন্তু সেই পোশাকগুলিকে দুস্থ , গরিব মানুষের কাজে লাগানোর জন্য এই বিনা পয়সায় বাজার । এসব পুরানো-নতুন জামা কাপড়গুলি নিয়ে আমরা পুরুলিয়া, মগরার দিবসুই ও আরামবাগের আন্তর্জাতিক গোসাই পরবে গিয়েছিলাম । কোরোনা পরিস্থিতির শুরুতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে ওষুধ আর্থিকভাবে অক্ষম মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি । বন্ধুরা আমার পাশে আছে । নিজেদের হাত-খরচ বাঁচিয়ে কেউ 100 টাকা, 200 টাকা বা 500 টাকা নিয়ে এগিয়ে এসেছে । আবার কেউবা দুই কেজি আলু কিনে দিয়ে লকডাউনে দুস্থদের পাশে দাঁড়িয়েছেন । লকডাউনে এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে অনেককেই সাহায্য করার চেষ্টা করেছি । আশপাশের দোকানদাররাও আমাকে বিশ্বাস করে এই দুঃসময়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন । "
দুঃস্থদের হাতে বস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে সুজিতবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁর বন্ধু থেকে সহকর্মীরা । এই বিষয়ে তাঁর সহকর্মী শিক্ষক ধীমান সানা বলেন , " যতটুকু সময় পাই , ততটুকু বিনা পয়সার বাজারে সুজিতদার সঙ্গে কাজ করি । এই 22 সেপ্টেম্বর "বিনা পয়সায় বাজার"-র এক বছর । তাই এটা আলাদাভাবে উদযাপন করার চিন্তাভাবনা করছি আমরা । এর মধ্যে বহু কাজ করেছি । আলমারিবন্দী মানুষের জামা কাপড় নিয়ে গরিবদের বিতরণ করেছি । দুস্থ ওই মানুষগুলির মুখে আনন্দ দেখে আমরা তৃপ্ত । দুইবার আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনের মানুষের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করেছি । লকডাউনের বাজারে বেশ কিছুদিন চুঁচুড়া হাসপাতালে রোগীর আত্মীয়দের রান্না করা খাবার তুলে দিয়েছি । এসব করতে গিয়ে দেখেছি বহু মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে ওষুধ না পেয়ে অসহায় অবস্থায় পড়ে আছেন । তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছি । মাসে মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে সমস্ত কিছু দেওয়ার ব্যবস্থা করছি । আমাদের এই ছোটো ভাবনাটাকে আরও বড় করার চেষ্টা করছি আমরা । "
তাঁর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে সাধারণ মানুষ । উপকৃতও হয়েছেন অনেকে । চুঁচুড়ার এক ছাত্রীর মা প্রিয়াঙ্কা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন , "সংসার চালাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি । তার উপর মেয়ের বই কেনায় সমস্যায় পড়েছিলাম । সেখান থেকে আমরা জানতে পারি এই বিনা পয়সার বাজারে বই পাওয়া যাবে । সেইমতো মেয়ের জন্য দুটো বইয়ের কথা বলি তাদের । দুটো বই পেয়ে আমার মেয়ের খুব উপকার হয়েছে । আমিও যদি তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারতাম , তাহলে আমারও ভালো লাগত । অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের বই-খাতা দিয়ে সহযোগিতা করেন তাঁরা । সেইসঙ্গে খেতে না পাওয়া মানুষের জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যান । "
বিনা পয়সার বাজার করে দুস্থদের পাশে চুঁচুড়ার শিক্ষক সুজিত দাস তবে এই পথ চলা ততটা সহজ ছিল না । অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে । তবে সব বাধা অতিক্রম করে আগামী দিনে এই বাজারকে আরও বড় করে তুলতে চান সুজিতবাবু ও এখানকার সদস্যরা । আরও বেশি করে দুস্থদের পাশে থাকতে চান এই শিক্ষক । তাঁর একটাই স্বপ্ন । ভারতের প্রতিটি শহর , গ্রামে এই ধরনের বিনা পয়সার বাজার গজিয়ে উঠুক । গরিব মানুষের সুরাহা হোক ।