চন্দননগরে মণ্ডল বাড়ির দুর্গাপুজো চন্দননগর, 30 সেপ্টেম্বর: চন্দননগর বললে প্রথমেই মাথায় আছে জগদ্ধাত্রী পুজো আর তার লাইটিং ৷ এর পাশাপাশি বিভিন্ন বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো আজও নজরকাড়া ৷ সেই সব পুজোর ঐতিহ্য আজও বর্তমান ৷ ফরাসি আমলে চন্দননগরে আড়ম্বরে পালিত হত দুর্গাপুজো। তৎকালীন সময়ে কিছু জমিদার ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতে ধূমধাম করে দুর্গোৎসব পালন করা হত ৷ আর সেই পুজোয় অংশীদার হতেন ফরাসিরাও ৷ 1824 সাল থেকে গোন্দল পাড়ার মণ্ডল বাড়িও সেই পুজো ও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে ৷
1741 সালে বিশাল ঠাকুর দালান সমেত পাশ্চাত্যের ছোঁয়ায় বাড়ি তৈরি করেছিলেন মণ্ডলদের পূর্বপুরুষরা। এই বাড়ির আনাচে কানাচে পাশ্চাত্য স্থাপত্যের ছাপ বর্তমান ৷ মণ্ডল পরিবারের সদস্য উজ্জ্বল মণ্ডল বলেন, "ব্যবসার জন্য জলপথে চন্দননগরে গঙ্গার ধারে এসে বসবাস শুরু করেন আমাদের পূর্ব পুরুষেরা। নুনের ব্যবসা ও জাহাজের মাধ্যমে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল পূর্বপুরুষরা। আমাদের কাকদ্বীপে বন্দর ছিল। 1824 খ্রিস্টাব্দে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আমাদের জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। সেই সময়ে পরিবারের এক সদস্য স্বপ্নাদেশ পান বাড়িতে দুর্গা পুজো করার।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হওয়ায় আমাদের পুজোতে কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। পাঁচ ধরনের ফলের রচনা করা হয় মন্দিরের চারদিকে। যাতে অশরীরি আত্মা কলা বউ বা পুজোর প্রসাদে দৃষ্টি না দেয়। পাশাপাশি, আমাদের পুজোয় ফরাসিরাও আসতেন ৷ অংশগ্রহণ করতেন ৷ আমাদের হল ঘরে গানবাজনা হত। ফরাসিদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল আমাদের পরিবারের।"
চন্দননগর গোন্দলপাড়ার মণ্ডল পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম একই রীতি ও নিয়ম মেনে দেবী উমার পুজো করে আসছেন ৷ 34 বছর আগে এই পরিবারে বিয়ে হয়ে আসেন বিদেশিনী নেলিন মণ্ডল। তিনি বেলজিয়ামের বাসিন্দা হলেও দীর্ঘদিন ফ্রান্সে ছিলেন। কর্মসূত্রে আলাপ উজ্জ্বল মণ্ডলের সঙ্গে। তারপরই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা। নেলিন বলেন, "আসলে আমি দু'দেশের মধ্যে কোনও পার্থক্য খুঁজে পাইনি ৷ ক্যাথলিক হয়ে জন্ম হলেও বিবাহ সূত্রে আমি হিন্দু হয়ে গিয়েছি। পুজোর অনেক দায়িত্ব থাকে আমার কাঁধে ৷ বাড়ির পুজো প্রতিপদ থেকে শুরু হয়। চারদিন ধরে পুজো চলে। গঙ্গায় বিসর্জন হয় মা দুর্গার।"
চন্দননগরের ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা বাসবী পাল জানান, মণ্ডল বাড়িতে ফরাসিরা আনাগোনা করতেন এটা খুবই স্বাভাবিক। ব্যবসা ক্ষেত্রে ওদের সঙ্গে ফরাসিদের যোগাযোগ ছিলই। বিভিন্ন দফতরের ফরাসি সাহেবদের তাঁদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান হত। এছাড়াও চন্দননগর খলিসানী বোসের জমিদার বাড়িতে ফরাসিদের আনাগোনা ছিল। সেই বাড়ির মানুষজন ফরাসিতে পঠন পাঠন করতেন। এই ধরনের একটা মেল বন্ধন ছিল বলে আমি মনে করি। ফরাসিরা সকল আনন্দে সামিল হতেন সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তী কালে চন্দননগরে বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়। ফরাসিদের উৎসাহ না থাকলে এই পুজোর এতো প্রসার ঘটত না।
আরও পড়ুন: জগদ্ধাত্রী মন্ত্রে পূজিতা সিনহা বাড়ির 500 বছরের প্রাচীন বুড়িমা চতুর্ভূজা
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, একচালায় মহিষাসুরমর্দিনী এখানে পূজিতা হন। সিংহবাহিনী মা দুর্গা তাঁর চার ছেলে মেয়ে নিয়ে অধিষ্ঠিতা এখানে। অসুরের গায়ের রঙ এখানে সবুজ। মা দুর্গা বৈষ্ণব মতে পূজিতা হন। কোনও বলি প্রথা নেই। মণ্ডলদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। পুজোর চারদিন কোন অন্য ভোগ হয় না। চালের নৈবিদ্য ও ফল দিয়ে পুজোর আয়োজন করা হয়।