সিঙ্গুর, 22 সেপ্টেম্বর : জমির অধিকারের লড়াইয়ে এক সময় উত্তাল হয়েছিল সিঙ্গুর । কৃষক অধিকারের জন্য চলেছিল অবিরত সংগ্রাম । আজ আবার প্রশ্নের মুখে কৃষকদের ভবিষ্যৎ । কেন্দ্রের কৃষি বিলের জন্য কৃষকদের স্বাধীনতা খর্ব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা । শ্রমের ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন না অনেক কৃষক । মধ্যপন্থী ব্যবসায়ীদের সরাতে গিয়ে পুঁজিপতিদের হাতে চলে যাবে কৃষি ব্যবস্থা, এই আশঙ্কাই সিঙ্গুরের কৃষক মহলে । প্রয়োজনে তাঁরা বড় আন্দোলনের পথে যাবেন বলেও হুঁশিয়ার করেছেন । 2006-এর মতোই কি আন্দোলনের সাক্ষী থাকবে সিঙ্গুর ? কৃষি বিল নিয়ে কী ভাবছেন কৃষকরা ?
20 সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় 'কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন' এবং 'কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত করতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি' সংক্রান্ত বিল পেশ হয় । চূড়ান্ত হই হট্টগোলের মধ্যেই ধ্বনি ভোটে পাশ হয়ে যায় বিল দু'টি । বিরোধীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন । রাজ্যসভার তৃণমূল সদস্য ডেরেক ও'ব্রায়েন সহ অন্যান্য সাংসদরা বিক্ষোভ দেখান । হাউজ় রুল বুক ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ ওঠে । এরপরেই আট সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয় । সংসদ চত্বরে অবস্থানে বসেন তাঁরা । আজ রাজ্যসভার অধিবেশন বয়কট করেন বিরোধীরা । তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন আট সাংসদও । এইদিকে বিরোধী শূন্য সংসদে পাশ হয়ে যায় তৃতীয় কৃষি বিলটিও । পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্য তেল অত্যাবশকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ে ।
বিরোধীরা বারবার অভিযোগ করেছে, কেন্দ্রের কৃষি বিল কৃষকের স্বার্থ বিরোধী । তার জেরেই বিক্ষোভ । যেভাবে রাজ্যসভায় বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধেও সরব বিরোধীরা । ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) কৃষকরা পাবেন না বলে আশঙ্কা করছে বিরোধীরা । কৃষিজমিতে বাজারের আধিপত্য বাড়বে । বড় ঠিকাদারদের দ্বারা কৃষক শোষণ বাড়বে, এমনকী কৃষকদের জমির অধিকার হারানোর ঝুঁকিও বাড়বে বলে আশঙ্কা বিরোধীদের ।
সিঙ্গুর : 2006
2006-র মে মাস । তৎকালীন বাম সরকার সিঙ্গুরে টাটা মোটর কারখানার জন্য 997 একর জমি বরাদ্দ করে । প্রায় 6 হাজার পরিবার তাঁদের জমি হারাচ্ছিলেন । কৃষকদের সমর্থনে পাশে দাঁড়ায় তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস । শিক্ষার্থী, বুদ্ধিজীবীরাও কৃষকদের পাশে দাঁড়ায় । ধর্মতলায় অনশন শুরু করেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।
জমির অধিকারের জন্য লড়ে সিঙ্গুর ( ফাইল ছবি )
একই সময়ে সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা সমিতির কর্মী তাপসী মালিকের মৃতদেহ উদ্ধার হয় । ধর্ষণও করা হয়েছিল তাপসীকে । 2008-র অক্টোবরে সিঙ্গুর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় টাটা । 2011-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, ক্ষমতায় এলে 400 একর জমি ফিরিয়ে দেবেন কৃষকদের । কৃষক আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছিল সিঙ্গুর তথা রাজ্য তথা দেশ ।
উদ্ধার হয় তাপসী মালিকের দেহ (ফাইল ছবি) এই মুহূর্তে কেন্দ্রের কৃষি বিল নিয়ে একাধিক মত পোষণ করছে সিঙ্গুরের কৃষক থেকে রাজনৈতিক দলগুলি । আসছে পক্ষ-বিপক্ষ মত । যে সিঙ্গুরে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল । সেই সিঙ্গুরে এই বিল কতটা মেনে নেবেন কৃষকরা ? না কি আবারও রুখে দাঁড়াবেন অধিকার বাঁচানোর লড়াইয়ে ।
কৃষকদের একাংশ মনে করছে, এই কৃষি বিল পাশের ফলেই কৃষি ক্ষেত্রে উন্নতি হবে । সঠিক দাম পাবেন কৃষকরা । অন্যদিকে জমি আন্দোলনের সেই কৃষকরা বিরোধিতা করেছেন কেন্দ্র সরকারের এই বিলের । অন্য অংশ আশঙ্কা করছে, কৃষিজাত পণ্যের দাম কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে চলে যাবে । বিলের জন্য কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবেন ? দালাল চক্রের হাত থেকে আদৌ কি মুক্তি পাবেন? এসব নিয়েই এখন প্রশ্ন সিঙ্গুরে ।
তৃণমূলের কৃষক নেতা মহাদেব দাস দাবি করছেন, মধ্যপন্থী ব্যবসায়ীদের সরাতে গিয়ে কর্পোরেট এবং পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে কৃষি ব্যবস্থা । ফলে কৃষকরা সঠিক দাম তো পাবেনই না । উপরন্তু ফসলের দাম নির্ধারণের স্বাধীনতা থাকবে না তাঁদের । মহাজনী প্রথার সঙ্গে তুলনা করছেন এই বিল পরবর্তী সময়কে । BJP সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন এই নেতা ।
অন্যদিকে সিঙ্গুরের BJP নেতা সঞ্জয় পাণ্ডে সাধুবাদ জানিয়েছেন এই বিলকে । তাঁর দাবি, কৃষকরা কৃষিজাত পণ্যের সঠিক দাম পান না । ফলে রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতে হয় । আত্মহত্যা করেন অসংখ্য কৃষক । সেই কারণে এই বিল অনেকটাই চাষিদের স্বার্থ রক্ষা করবে ।
এই বিল আসার পরে আদৌ কতটা স্বার্থ রক্ষা হবে তা সময় বলবে । কৃষকদের জমির দাম নির্ধারণের অধিকার থাকছে না, এই বিষয়ে নিশ্চিত । কিন্তু বহুজাতিক সংস্থাগুলি কৃষকদের কি আদৌ সঠিক দাম দেবে ? মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর কতটা প্রভাব পড়বে, তা এখনও ধোঁয়াশায় । কিন্তু কৃষক অধিকারের জন্য কি আবার জাগবে সিঙ্গুর ? অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে লড়বে অধিকারের লড়াই ?