চন্দননগর, 15 অগস্ট : স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁতুরঘর ছিল চন্দননগর। ফরাসি উপনিবেশ থাকাকালীন চন্দননগরের বোড়াই চণ্ডীতলায় শুরু হয়েছিল বিপ্লবী কার্যকলাপ। নিজের বাড়িতেই বিপ্লবীদের আত্মগোপনের ঠিকানা করে দিতেন মতিলাল রায়।
তৎকালীন সময়ে ঋষি অরবিন্দের হাত ধরে চরমপন্থী আন্দোলনে যোগ দেওয়া। বারীন্দ্রকুমার ঘোষের প্রেরণায় মতিলাল রায়, অধ্যাপক চারুচন্দ্র রায়, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, কানাইলাল দত্ত ও নগেন্দ্রনাথ ঘোষদের নিয়ে 1907 সালে চন্দননগরে বিপ্লবী কার্যকলাপের সূত্রপাত হয়।
মতিলালই নরেন গোস্বামীকে মারতে কানাইলাল দত্তের হাতে রিভলভার তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতেই অরবিন্দ গোপনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাসবিহারী বসুকে শুধু উদ্বুদ্ধই করেননি তাঁকে জাপানে পালাতে সাহায্য করেছিলেন এই মতিলাল রায়।
আরও পড়ুন : Netaji Subhas Chandra Bose : নজরবন্দি হয়েও অপ্রতিরোধ্য নেতাজি, গোপন চিঠি পাঠাতেন পাউরুটির স্লাইসে
তিনি শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে সামিল হননি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ভারতের যুবকদের স্বাধীনতার চেয়েও দরকার শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সাম্বলম্বী হওয়া। তাহলেই আসল স্বাধীনতা পাবে বাংলা তথা ভারত। সেই কারণেই অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন তিনি। সেই সঙ্গে প্রবর্তক পত্রিকা ও প্রবর্তক সংঘের সৃষ্টি করেন। আর ধীরে ধীরে বিপ্লবী থেকে সঙ্ঘ গুরু হয়ে ওঠেন মতিলাল। তাঁর এই প্রবর্তক সঙ্ঘে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ একাধিক ব্যক্তিত্ব।
মতিলালের এই স্মৃতি মন্দির কিন্তু এই বিপ্লবীর স্থান ও প্রবর্তক সংঘ আজ অনেকটাই অবহেলিত। মতিলালের এই স্মৃতি মন্দির, তাঁর বিভিন্ন কাজ-সংগ্রহ, দুষ্প্রাপ্য ছবিগুলিকে নিয়ে সংগ্রহশালা ও পর্যটনকেন্দ্র গড়ার দাবি তুলেছেন সংঘের কর্মকর্তারা।
মতিলাল রায়ের প্রবর্তক আশ্রম ও মন্দির বোড়াই চণ্ডীতলায় আজও বিদ্যমান মতিলাল রায় 1883 খ্রিস্টাব্দে চন্দননগরের বোড়াই চণ্ডীতলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কর্মসূত্রে কলকাতায় প্রথম দিকটা থাকলেও পরে চন্দননগরে চলে আসেন। মতিলাল রায়ের স্ত্রী রাধারানী দেবী ও তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিয়ে থাকতেন। কিন্তু কন্যার মৃত্যুর পর সাংসারিক জীবনে আবদ্ধ না থেকে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত হন মতিলাল।
আরও পড়ুন : Mahatma Gandhi : বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিল ও গান্ধির কিছু স্মৃতি
স্বদেশী আমলে তাঁর বাড়িতেই বোমা বাঁধা হত। বিপ্লবীদের একপ্রকার অবারিত দ্বার ছিল মতিলালের বাড়ি। এখানেই আত্মগোপন করেছিলেন ভারতবর্ষের বহু বিপ্লবী। বিপ্লবী কার্যকলাপ ধরার জন্য ও মতিলালকে ধরতে ইংরেজ পুলিশরা তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে।
তবে প্রমাণের অভাবে চলে যেতে বাধ্য হয় সেখানে থেকে। পরবর্তীকালে ঋষি অরবিন্দের অনুপ্রেরণায় সশস্ত্র বিপ্লব থেকে সরে গিয়ে প্রবর্তক আশ্রমের সূচনা করেন তিনি ৷ পরে বিপ্লবী আস্তানাই প্রবর্তক আশ্রমে পরিণত হয়। তৈরি হয় দুঃস্থদের জন্য স্কুল ৷ পরবর্তীকালে এই আশ্রমে আসেন রবীন্দ্রনাথ,গান্ধিজির মত মনীষীরা ৷ এছাড়াও প্রবর্তক আশ্রমে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়-সহ একাধিক ব্যক্তিআসেন ৷
একাধিক ছবি, বই ও নানা জিনিস সংগৃহীত আছে এই আশ্রমে। আর প্রবর্তক সেবা নিকেতনে গান্ধিজির চরকা ও বিপ্লবী আন্দোলনের সেই বন্দুক এখনও সুরক্ষিত আছে।
আরও পড়ুন : Independence Special : ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে 32 জন শহিদ হন কর্নাটকের জালিয়ানওয়ালাবাগে
মতিলাল রায়ের প্রবর্তক আশ্রম ও মন্দির বোড়াই চণ্ডীতলায় আজও বিদ্যমান। তাছাড়াও প্রবর্তক নামে একাধিক প্রাথমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মেয়েদের জন্য প্রবর্তক সেবা নিকেতন, বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, প্রবর্তক কলেজ অফ কালচার ,প্রবর্তক চতুষ্পাঠী সহ দক্ষিণ 24 পরগনায় আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন কেন্দ্র আছে।
সেই সঙ্গে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, শাকপুরা, ফরিদপুর একাধিক জায়গায় বিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল । তৈরি হয়েছিল প্রবর্তক গ্রন্থাগার ও প্রবর্তক প্রেস। কিন্তু কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া মতিলালের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অংশগুলি নষ্ট হতে বসেছে।
সকলেই চান, এগুলি আরও ভাল ও সুন্দর করে তৈরি হোক।তাহলে বিপ্লবের এই পীঠস্থান চন্দননগর পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠবে।
প্রবর্তক সেবা নিকেতনের সভাপতি পরিমল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, প্রবর্তকের নামে গঙ্গার ধারে এখনও সম্পত্তি আছে ৷ আমরা চাই, চন্দননগরের বিধায়ক ইন্দ্রনীল সেন প্রবর্তক সংগ্রহশালা এবং পর্যটনের ব্যবস্থা করুন ৷
আরও পড়ুন :Bhagat Singh : খণ্ডঘোষের পাতাল ঘরে বসেই দিল্লি গণপরিষদে বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনা ভগৎ সিংয়ের
প্রবর্তক আশ্রমের সদস্য প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "প্রবর্তক আশ্রম 100 বছরের উপর সেবা দিয়ে চলেছে ৷ এখন রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্র সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন প্রবর্তকের ৷ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নষ্ট হতে বসেছে, তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করুক সরকার।"