পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

"বাঘ বিধবাদের" কান্নায় ভারাক্রান্ত সুন্দরবন, বিকল্প জীবিকা কই ? - tiger-widows are increasing in sunderban

সুন্দরবনের জঙ্গলে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের হানার শিকার হচ্ছে একের পর এক মৎস্যজীবী। তাঁদের মৃত্য়ুর পর কী হচ্ছে পরিবারের?

tiger widows
বাঘ বিধবা

By

Published : Feb 29, 2020, 9:13 PM IST

Updated : Mar 15, 2020, 4:20 PM IST

সুন্দরবন, 29 ফেব্রুয়ারি : সুন্দরবন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য। জীব বৈচিত্রে সমৃদ্ধ। এর সৌন্দর্যও প্রশ্নাতীত। কথায় বলে, সুন্দর জিনিসে একটা ভয়ঙ্কর দিক লুকিয়ে থাকে। যেমনটা আছে- এই সুন্দরবনেও। এখানকার জীববৈচিত্রের উপর নির্ভর করে যেসব মানুষ রুজিরুটি অর্জন করেন, তাঁদের অনেকের কাছেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এই সুন্দরবন। এক্ষেত্রে প্রথমেই উঠে আসে মৎস্যজীবীদের কথা। পেটের দায়ে মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের হানার শিকার হচ্ছেন একের পর এক মৎস্যজীবী। ফলে, দিন দিন বাড়ছে বাঘ বিধবার সংখ্যা। গত একবছরে বনদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, ৪ জন বাঘের হানায় প্রাণ হারিয়েছেন। বেসরকারি হিসেবে সেই সংখ্যাটা-১১ (অন্য একটি বেসরকারি হিসেবও রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, গত প্রায় ১৫ বছরে ব্যাঘ্র প্রকল্পের আওতায় বাঘ বিধবার সংখ্যা প্রায় 750 জন। সমগ্র দক্ষিণ 24 পরগনায় যে সংখ্যাটা দেড় হাজারের বেশি)।

বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব। তাই গোসাবা, বাসন্তী, ক্যানিং, কুলতলি, সাগর, রায়দিঘিসহ দক্ষিণ 24 পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকার বহু সংখ্যক মানুষ মাছ ধরতে যান সুন্দরবনে। পরিবারকে উৎকণ্ঠায় রেখে-প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই শিকারে বেরোতে হয় তাঁদের। মূলত- বিদ্যাধরী, মাতলা ও কলস নদীতে মাছ ধরেন। তবে ছোটোখাট শাখানদীও রয়েছে যেখানে মাছ পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, জোয়ারের টানে নদীখাঁড়িতে প্রচুর সংখ্যক মাছ ঢুকে পড়ে। যা ভাটার সময় দ্রুত ফিরতে পারে না। সেই সুযোগকেই কাজে লাগান মৎস্যজীবীরা। নদীতে নেমে পড়েন মাছ ধরতে।

মাছ ধরাই জীবীকা সুন্দরবনের অধিকাংশ মানুষের

এপর্যন্ত ঠিকই ছিল। নৌকা থেকে মাছ ধরলে সেঅর্থে বিপদের মুখে পড়তে হয় না। কিন্তু, অধিকাংশ মৎস্যজীবীর টার্গেট থাকে কাঁকড়ার। কারণ, কাঁকড়া বেচে বেশি টাকা আয় হয়। প্রতি কেজি বড় কাঁকড়ার বাজারমূল্য 800-1000 টাকা। একটু বেশি করে ধরতে পারলেই অনেক টাকা রোজগার করা যায়। তাতে বেশ কয়েকদিন হেসে-খেলে কেটে যায় পরিবারকে নিয়ে। অধিক লাভের আশাই কাল হয়ে দাঁড়ায় মৎস্যজীবীদের কাছে। কাঁকড়া ধরতে নেমে পড়েন নৌকা থেকে। জঙ্গলের আশপাশে যেসব গর্ত থাকে সেখানে লোহার শিক ঢুকিয়ে কাঁকড়া ধরেন। ব্যাস, আর রক্ষে থাকে না। ওঁত পেতে থাকা বাঘ কি এই সুযোগ গ্রাসছাড়া করে ? নিমেষের মধ্যে আক্রমণ চালায় মৎস্যজীবীর উপর। নেতিধুপানি, পিরখালি জঙ্গলে আকছার এধরনের ঘটনা ঘটে।

পেটের দায়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে যান মৎস্যজীবীরা

দিনকয়েক পর পরিবারের কাছে আসে দুঃসংবাদ। সুন্দরবনের গোসবা ব্লকের আমলামেতি গ্রামের শ্রীনাথ মণ্ডল, সুবল সর্দাররা মৎস্য শিকারে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি। ফলে, বয়সের আগেই বিধবা হতে হয়েছে তাঁদের স্ত্রীদের। 23 নভেম্বর গোসাবা আমলামেথি গ্রামের বাসিন্দা অনিল মণ্ডলকে কাঁকড়া ধরার সময় তুলে নিয়ে যায় বাঘ। গোসাবার কুমিরমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের মৃধাঘেরি এলাকার বাসিন্দা দুর্গাপদ মণ্ডলেরও মৃত্যু হয়েছে বাঘের হামলায়।

মর্মান্তিক সেই ঘটনার কথা জানিয়েছেন শ্রীনাথ মণ্ডলের স্ত্রী রীতা মণ্ডল। তাঁর কথায়, "স্বামী মাছ ধরতে গিয়েছিল। বলেছিল, তিনদিন পরে চলে আসবে। কিন্তু, আসেনি। ভাবলাম, পরের দিন সকালে চলে আসবে। তাই সকাল সকাল ভাত বসিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি, সাংবাদিকরা আসছেন। রাস্তার বাইরে-ঘরের সামনে সর্বত্র লোকজন। তখন বুঝতে পারলাম, কিছু একটা হয়েছে। রাস্তায় গেলে অন্যরা আমাকে বাড়ি নিয়ে চলে আসে। তখন জানতে পারি স্বামী মারা গেছে। অনেকে গিয়েছিল দেহ আনতে। একটি ভ্যানে দেহ নিয়ে আসা হয়। সেই ভ্যানটিই দেহ দাহ করতে নিয়ে গিয়েছিল। ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোথায় যাব। ভাবলাম, আমি বিয়ে করলে ছেলে-মেয়েদের কে দেখবে। তখন বয়স কম ছিল। কলকাতায় মায়ের কাছে গিয়েছিলাম। একটা ভাঙা ঘর ছিল। মেয়েটা বোনের বাড়িতে থেকে মানুষ হয়। এখন এখানে ছেলে-মেয়ে নিয়েই থাকি।"

"বাঘ বিধবাদের" কান্নায় ভারাক্রান্ত সুন্দরবন

শ্রীনাথের সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন। মনোরঞ্জন ও সুবল। তাঁরা কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে লোকালয়ে ফিরে আসেন। এলাকার কয়েকজনকে জোগাড় করে শ্রীনাথকে বাঁচাতে যান। সেইসময় জঙ্গল থেকে আরও একটি বাঘ বেরিয়ে এসে তাঁদের উপর হামলা চালায়। মনোরঞ্জন বাঁচলেও, রক্ষা পাননি সুবল। হাড়হিম করা সেই ঘটনার কথা প্রসঙ্গে মনোরঞ্জন বলেন, "আমার সামনেই সুবলকে নিয়ে চলে যায় বাঘে। শ্রীনাথের রক্তাক্ত দেহের অর্ধেকটা পেয়েছিলাম। ওইসময় বাঘ আমাকে আক্রমণ করে। আমি যখন রক্তাক্ত অবস্থায় পাশে পড়ে আছি, বাঘ উঠে গিয়ে সুবলকে টেনে নিয়ে যায়। বাকিদের মধ্যে কেউ গাছে উঠে যায়, কেউ নৌকায় চড়ে। কয়েকজন আমাকে ধরে নৌকায় নিয়ে যায়। এখনও বন্ধুদের জন্য কষ্ট হয়। আমার তো কিছু করার নেই। এখন চাষ করে খাই। অন্য সঙ্গীদের বলেছি, ওই ভয়ঙ্কর জায়গায় যাওয়ার কোনও দরকার নেই। গ্রামাঞ্চলেই কাজকর্ম করো।

মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের হামলার মুখে পড়েন স্থানীয় বনিতা মণ্ডলের স্বামীও।

এভাবে অসময়ে স্বামীকে হারিয়ে অথৈ জলে পড়ছেন বাঘ বিধবারা। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কী করবেন, কোথায় যাবেন- তার সুরাহা করতে গিয়ে অনেককেই পড়তে হচ্ছে বিপদে। দীর্ঘদিন সুন্দরবনের শিক্ষা-সংস্কৃতি, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, তাঁদের স্বনির্ভর করার কাজ করছেন বাসন্তী হাইস্কুলের শিক্ষক তথা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অধিকর্তা অমল নায়েক। বলেন, "এই বিধবাদের জীবনে মারাত্মক সমস্যা নেমে আসছে। এদের এনেকে গৃহচ্যুত হচ্ছেন। এদের অনেককে ভুল বুঝিয়ে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, পুণে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদের একাংশকে পাচার করা হচ্ছে। কাউকে কাউকে কাজ দেওয়ার নাম করে পতিতালয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এদের সাহায্য করার জন্য আমরা "সেভ টাইগার অ্যাফেক্টেড ফ্যামিলি স্টাফ" নামে সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপে বিধবাদের সমবেত করেছি। তাঁদের বাঁচার সন্ধান দিয়েছি। ছাগল, হাঁস, মুরগি পালনের মাধ্যমে, হাতের কাজ করিয়ে, ছোটোখাট বিভিন্ন ব্যবসার কাজ করিয়ে তাঁদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছি। আমাকে কিছু মানুষ সাহায্য করেন। কিন্তু, দিনদিন ব্যাঘ্রবিধবার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। একমাসের মধ্যে পাঁচজন বাঘ বিধবা হয়েছেন। এদের সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওরা শিশুশ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। আমি চেষ্টা করছি, তাদের ফিরিয়ে এনে স্কুলে ভরতি করা। সরকারের এবিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এই বিধবাদের স্বাবলম্বী করার জন্য আরও মানুষ পাশে এসে দাঁড়াক, এই আহ্বান জানাচ্ছি।"

মৎস্যজীবীরা সরকারি অনুমতি ছাড়াই জঙ্গলে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের হামলার মুখে পড়েছেন, বলছে বনবিভাগ। এপ্রসঙ্গে সুন্দরবনের ফিল্ড ডিরেক্টর সুধীর দাস বলেন, "অনেকে কাঁকড়া ধরতে জঙ্গলে নামেন। তারজন্যই মারা যাচ্ছেন। এঁরা নৌকায় থাকলে মারা যাবেন না। ওঁদের বোঝানোর চেষ্টা করছি, জঙ্গলে নামবেন না। নৌকায় যে পদ্ধতিতে কাঁকড়া ধরা হয়, সেই পদ্ধতিতে ধরুন। অতি লোভের জন্য বাঘের পেটে যাচ্ছেন। বনদপ্তরের তরফে সারাবছর সচেতন করা হয়। কিন্তু, অবৈধভাবে ঢুকে দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা মান্যতা দেব না। সুন্দরবনের এত বড় এরিয়ার জন্য অত স্টাফ নেই যে সব জায়গায় লোক বসানো যাবে। মানুষ সচেতন হলে এটা কমবে।"

কিন্তু, বিকল্প রোজগারই বা কোথায়? কীভাবে চলবে তাঁদের পেট? তাই-কাঁকড়া, মধু বা মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়তেই হয়। এনিয়ে গোসাবার BDO সৌরভ মিত্র বলেন, "বিকল্প জীবিকা জোগানের চেষ্টা করব। এছাড়া যে কোনও ছোটোখাট কাজ করার জন্য ওঁরা লোন পাচ্ছেন। সেদিকটাও আমর দেখছি। অনেকে সেলাই, হাঁস-মুরগি প্রতিপালনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। জঙ্গলের উপর নির্ভরশীলতার দুটো কারণ। কাঁকড়া-মাছের দাম। চড়া দামে বিক্রি হয়। দ্বিতীয়ত, অনেকেই অভ্যাসবশত জঙ্গলে যাচ্ছে। বাজার-দোকান আছে, তার পরেও কেউ কেউ জঙ্গলে যাচ্ছেন।"

বাঘের হানায় মৃতদের ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "বাঘ বিধবাদের দু'ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। একটা হচ্ছে, বনদপ্তরের ক্ষতিপূরণ। সেক্ষেত্রে মৃতদেহ পাওয়া খুব জরুরি। মৃতদেহ পাওয়া গেলে ফরেস্টের ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। তারজন্য যাবতীয় যা সাহায্য করা-যোগাযোগ করানো, বনদপ্তরকে নির্দেশ পাঠানো, রেঞ্জ অফিসারদের সঙ্গে কথা বলা, দরকারে ফিল্ড ডিরেক্টরের সঙ্গে কথাও বলি। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ 4 লাখ টাকা। অনেকক্ষেত্রে বনদপ্তরের ক্ষতিপূরণ পেতে অসুবিধা হচ্ছে মাঝিদের জন্যেই। কারণ, ওঁরা কোর এরিয়াই ঢুকে যাচ্ছেন। যেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ। জেলের কাগজপত্র থাকলে- ফরেস্টে না হলে আমরা মৎস্য দপ্তরে পাঠাই। সেখানে 2 লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। তার পরেও কিছু না হলে, ফ্যামিলি বেনিফিট স্কিমে 40 হাজার টাকা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।"

Last Updated : Mar 15, 2020, 4:20 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details