পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

সাগরে পুণ্যস্নানের কার্নিভাল...

কথিত আছে, মকর সংক্রান্ত লগ্নে সাগর-সঙ্গমে ডুব দিলেই পুণ্য মেলে । তাই পুণ্যলাভের আশায় প্রতি বছর এই সময়ে সাগরের টানে ভিড় হয় পুণ্যার্থীদের । আশ্রম, মঠ, পাহাড় থেকে সাধুসন্তদের ঢল নামে সাগরে । আসেন নাগা সন্ন্যাসীরাও ।

By

Published : Jan 14, 2021, 8:02 PM IST

গঙ্গাসাগরের মেলা
গঙ্গাসাগরের মেলা

সাগর, 14 জানুয়ারি : প্রতি মূহূর্তেই কিছু না কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায় গঙ্গাসাগর । বদলের নিজস্ব সমীকরণ রয়েছে সাগর দ্বীপের এই পুণ্যভূমিতে । নদী-পাহাড়-উপত্যকার মতো এই সাগরও যেন বড্ড জীবন্ত ।

এই পুণ্য তিথিতে যাঁরা গঙ্গাসাগরে আসেন, তাঁরা অনেকেই বছরের পর বছর আসতে আসতে একে অন্যের মুখ চিনে গেছেন । তবে কচুবেড়িয়ার স্টিমার ঘাটে এই বছর ভিড়ের বহর অনেকটাই কম । সেখানে কোনও অজানা মুখ কোনও চেনা মুখের অপেক্ষায় ।

সারা বছর মেলা থেকে মেলায় মিস্টির পসরা নিয়ে বিকিকিনি করে বেড়ান ডায়মণ্ড হারবারের সুজন সামন্ত । বয়স বছর তিরিশের আশেপাশে । পরিবারের একমাত্র রোজগেরে বলতে তিনিই । কোরোনা ভাইরাসের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিগত বছরে সেভাবে মেলা বসেনি । পাঁচ জনের সংসারের ভার নিয়ে শেষ সালটা প্রায় ঘরেই বসে থাকতে হয়েছে সুজনকে । গঙ্গাসাগরে এসেছেন লাভের আশায় । বৃহস্পতিবার সকালে দেখা হতে বললেন, তাঁর মিস্টি অনেকটাই বিক্রি হয়েছে । অথচ দু'দিন আগেও ফাকা মেলা চত্বর দেখে মুখ চুন করে বসে ছিলেন । এক অন্ধকার সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব । মুখে বাধ্যতামূলক মাস্ক । হালকা ভয়ও ছিল মনে । বিক্রি-বাট্টা হবে তো ! তবু এক অদম্য অকুতোভয় মানসিকতা । শেষে লক্ষীবারে লক্ষীলাভ ।

কোরোনা বিধি মেনেই চলছে গঙ্গাসাগরের মেলা

ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত শঙ্খধ্বনি ভেসে আসে গঙ্গাসাগরে । কপিলমুনির আশ্রমের অনতিদূর থেকে প্রায় সাগরতট পর্যন্ত শাখ এবং শাখার পসরা । আর শাখার দোকানগুলির ঘিরে রয়েছে পুণ্যার্থীদের ভিড় ।

গঙ্গাসাগর এইবার, শুদ্ধিকরণ বারবার

কোরোনা মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে গেছে । বাহুল্যের বদলে পরিমিতভাবে বাঁচার শিক্ষা দিয়েছে কোরোনা । তাই সাগরদ্বীপে এবার পুণ্যার্থীদের প্রতিটি পদক্ষেপে হাত ধরাধরি করে রয়েছে বিশ্বাস এবং জীবনে বাচানোর লড়াইয়ের গল্প । রয়েছে প্রশাসনের কড়া নজরদারি । থেকে থেকে মাইকিং চলছে । মাস্ক-স্যানিটাইজ়ার ব্যবহারের জন্য বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে মাইকে । যদি কারও সঙ্গে মাস্ক বা স্যানিটাইজ়ার না থাকে, তাঁদের নিকটবর্তী ভলান্টিয়ার (সাগরবন্ধু)-দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে । তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও ছিল যথেষ্ট চোখে পড়ার মতো ।

গঙ্গাসাগরের মেলায় ভিড় জমিয়েছেন সন্ন্যাসীরা

আরও পড়ুন : গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানাল রাজ্য

এ এক অন্য জীবনযুদ্ধের গল্প

সাগরদ্বীপের মেলায় বিভিন্ন ধরনের জীবনযুদ্ধের ছবি ধরা পড়ে । ফি বছর সাগর মেলায় বহু মানুষ গঙ্গার উদ্দেশে গয়না-অলংকার নিবেদন করে থাকেন । আর দ্বীপের স্থানীয় কিছু মহিলা জলে ডুব দিয়ে সেই গয়না-অলংকার তুলে আনেন । বছরভর পুণ্যার্থীদের উৎসর্গ করা গয়না তুলে এনেই পেট চলে ওঁদের । দিনের শেষে সেই গয়না এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেন । এটাই রোজগারের পথ ।

কোরোনার কারণে বিগত বছরের সিংহভাগ সময় কোনও পুণ্যার্থীর পা পড়েনি সাগরে । ফলে রোজগার বন্ধ ছিল ওই মহিলাদের । বর্তমানে সময় বদলেছে । বিধিনিষেধের বেড়ি পরেও মেলা বসেছে মন্দির চত্বরে । জীবন চালাতে ফের জলে ঝাপ দিচ্ছেন গাঁয়ের ওই বধূরা ।

দিনের আলো আরও কিছুটা বাড়তেই সাগরতটে পসরা জমতে শুরু করে । পসরা সাজিয়ে বসেছেন গ্রামের মানুষরাই । হাট বসেছে সাগরতটে । উচ্ছে, বেগুন, কফি, মুলো, বেত, কাঠের ধামাকুলো... কি নেই ! সরষে, ছোলা, ময়দা, আটা, শীতের নকশা কাটা চাদর সবই রয়েছে হাটে । মায় রঙবাহারি খাবারের দোকানও রয়েছে । ভিড় জমেছে খদ্দেরদেরও ।

নিউ নর্মালে সাগরদ্বীপ, কোরোনা বিধি মেনেই চলল মেলা

সাগর সঙ্গমে সাঁতার কেটেছি...

কলকাতা থেকে সাগরদ্বীপের দূরত্ব একশো কিলোমিটার । গঙ্গার সঙ্গম হয়েছে এখানে বঙ্গোপসাগরে । এখানেই রয়েছে কপিল মুনির আশ্রম । এখনও পর্যন্ত এই আশ্রম তিনবার সাগরের গ্রাসে চলে গিয়েছে । কিন্তু সমুদ্র যে সবকিছু ফিরিয়ে দেয় । বর্তমান যে মন্দিরটি রয়েছে সেটি কপিল মুনি আশ্রমের তৃতীয় সংস্করণ । এই তৃতীয় সংস্করণটি মূল আশ্রম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে তৈরি হয়েছে । প্রতিষ্ঠাতা অযোধ্যার হনুমান গড়ি মঠের মোহন্ত রামদাসজি মহারাজ ।

মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে পুণ্য স্নান

কথিত আছে, মকর সংক্রান্ত লগ্নে সাগর-সঙ্গমে ডুব দিলেই পুণ্য মেলে । তাই পুণ্যলাভের আশায় প্রতি বছর এই সময়ে সাগরের টানে ভিড় হয় পুণ্যার্থীদের । আশ্রম, মঠ, পাহাড় থেকে সাধুসন্তদের ঢল নামে সাগরে । আসেন নাগা সন্ন্যাসীরাও ।

গায়ে ছাই মেখে মহেন্দ্রগিরি নাগা সন্ন্যাসীরাও রয়েছেন তাঁদের মতো করে । মুখে মাস্কের বালাই নেই । এদের কি কোনও ভয় নেই । নাগা সন্ন্যাসীরা কিন্তু বলছেন, মাস্ক নয়, ছাই মেখেই কোরোনার বিরুদ্ধে লড়াই তাঁদের । বলছেন, "জীবানু শরীরকে আক্রমন করে । আমাদের তো শুধু আত্মা । শরীর ত্যাগ তো কবেই করেছি । তাই আত্মার তল পায় না কোরোনার জীবাণু ।"

তবে আধ্যাত্মিকতা ছাপিয়ে গঙ্গাসাগরে এখন কসমোপলিটান কালচার । যেখানে ভক্তি এবং জীবন,পায়ে পায়ে চলে । গোরুর লেজ ধরে বৈতরণী পার হওয়ার আধ্যাত্মিক সুখের ছবি রয়েছে । পাশাপাশি আছে সেলফিতে সাগরস্নানের উৎসবকে ধরে রাখার আধুনিক প্রয়াস । বার্ধক্য যেন মুখ ঢেকেছে তারুন্যের রোমান্টিকতায় । প্রতি মূহূর্তে নিজস্ব ছবি তুলে ধরে সাগর । কখনও সে বড্ড আধ্যাত্মিক, আবার কখনও রূপ নেয় পুণ্যার্থীদের কার্নিভালে ।

যেখানে প্রতিটা মূহূর্তে সাগরের ছবি বদলাচ্ছে, সেখানে আবহাওয়াই বা আর বাদ যায় কেন । গঙ্গা সাগরে মকর-স্নান মানেই হাড়কাপানো ঠান্ডার সঙ্গে দ্বৈরথ । তবে বেলা বাড়তেই উচ্চমুখী পারদে প্রাকগ্রীষ্মের আগমনী ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details