কলকাতা, 23 জুন : বিহারে এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে শতাধিক শিশুর মৃত্যু হয়েছে । কিন্তু কী এই অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিনড্রম (AES ) ? AES-এর সঙ্গে লিচুর কি কোনও সম্পর্ক রয়েছে ? তাহলে কি লিচু খাবেন না ? শিশুদেরও কি লিচু খাওয়ানো যাবে না ? এরকম নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন চিকিৎসক প্রভাস প্রসূন গিরি ।
AES (অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম) আসলে কী ?
AES নির্দিষ্ট কোনও একটি অসুখের নাম নয় । এটি বড় একটি আমব্রেলা টার্ম । যাতে সহজেই অসুখটিকে চিহ্নিত করা যায় । যে কোনও শিশু অথবা বয়স্ক মানুষের যদি জ্বর ও তার সঙ্গে মাথা ব্যথা, বমি, জ্ঞান ঠিকঠাক থাকছে না, ভুল বকছে, ডিসওরিয়েন্টেড হয়ে যাচ্ছে, বেশি ঘুমোচ্ছে, জ্ঞান চলে যাচ্ছে, সঙ্গে যদি খিঁচুনি থাকে তা হলে এই ধরনের উপসর্গগুলিকে বলা যেতে পারে AES ।
এই সংক্রান্ত আরও পড়ুন : 2 দিনে 36 শিশুর মৃত্যু; মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, "খালি পেটে লিচু খাওয়াবেন না"
এই AES-এর উপসর্গগুলি নিয়ে যে সব অসুখ দেখা দিতে পারে তার মধ্যে প্রধান দুই-তিনটি হল মেনিনজাইটিস, এনসেফ্যালাইটিস ও স্ক্রাব টাইফাস । এক, মেনিনজাইটিস- ব্রেনের চারদিকে মেনিনজাইস নামে পর্দা থাকে । এই পর্দায় সংক্রমণ হয় । প্রধানত ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয় । দুই, এনসেফ্যালাইটিস- ব্রেনের যে ঘিলু তার মধ্যে সংক্রমণ হয় এক্ষেত্রে । বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের কারণে এই সংক্রমণ ঘটে । তিন, স্ক্রাব টাইফাস- কোনও কোনও ক্ষেত্রে AES-এর মতো উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয়। এছাড়াও সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গিও AES-এর মতো উপসর্গ নিয়ে হাজির হয় । কিছু টক্সিন ইনডিউসড, বিষাক্ত পদার্থ শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটালেও AES-এর মতো উপসর্গ দেখা দেয় ।
এই সংক্রান্ত আরও পড়ুন : 'কটা উইকেট পড়ল ?' শিশুমৃত্যু নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকের মাঝে মন্ত্রীর প্রশ্ন ঘিরে বির্তক
বিহারে যে ঘটনাটি গত 2-3 বছর আগে ঘটেছিল তাতেও প্রচুর বাচ্চা মারা যায় । প্রথমে মনে হচ্ছিল এটা AES অর্থাৎ এনসেফ্যালাইটিস । ব্রেনে কোনও ভাইরাস সংক্রমণের কারণে ব্রেনে ইনফেকশন হওয়ার কারণে বহু শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বহু শিশুর মৃত্যু হচ্ছে । এর পরে আন্তর্জাতিক একটি বিষেশজ্ঞ দল এবং এদেশের বিশেষজ্ঞরা মিলে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন । তাঁরা জানান, এই AES কোনও ভাইরাল এনসেফ্যালাইটিস বা ব্রেনের সংক্রমণের জন্য নয় । এই পুরো বিষয়টাই ঘটছে লিচু খাওয়ার জন্য ।
এই সংক্রান্ত আরও পড়ুন :এনসেফ্যালাইটিসে বিহারে মৃত বেড়ে 128
তবে লিচু খেলেই কি AES দেখা দেবে ? ছোটরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, খিঁচুনি হবে, এমন কী মৃত্যুও হতে পারে?
ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, লিচুর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে দুটি টক্সিন থাকে । এক, হাইপোগ্লাইসিন ও দুই, MCPG । এই দুই টক্সিন কী করে? যাদের শরীরে গ্লাইকোজেনের স্টোরেজ কম অর্থাৎ শারীরিক গঠন রোগা-পাতলা, ভালো পুষ্টিকর খাবার খায় না তারা যদি প্রচুর পরিমাণে লিচু খায় তাহলে লিচুর এই দুই টক্সিন শরীরে গ্লুকোজ বা শর্করার পরিমাণ অত্যন্ত কমিয়ে দেয়। যদি খালি পেটে লিচু খায় তাহলেও একই ঘটনা ঘটে । শরীরে শর্করার পরিমাণ কমে যাওয়াকে বলা হয় হাইপোগ্লাইসিমিয়া । এর জেরে মানুষ অচৈতন্য হয়ে পড়ে । শরীরে শর্করার পরিমাণ কমে গেলে, শরীর নিজস্ব নিয়ম অনুসারে শরীরের বিভিন্ন স্থানে শর্করা তৈরির চেষ্টা চলতে থাকে । এক্ষেত্রে শরীরের অবশিষ্ট ফ্যাট বা চর্বি থেকে শারীরিক প্রক্রিয়ায় শর্করা তৈরি হতে থাকে । এর বাই-প্রোডাক্টস হিসাবে কয়েকটি মেটাবোলাইটস, টক্সিন তৈরি হয় । এগুলি অতিরিক্ত পরিমাণে তৈরি হওয়ার ফলে ব্রেনকে এফেক্ট করে । এর ফলে জ্ঞান চলে যায়, খিঁচুনি হয়, কোমায় চলে যায় আক্রান্ত, এমন কী মৃত্যু পর্যন্ত হয় । একে বলা হয় মেটাবলিক এনসেফালোপ্যাথি । এটা এনসেফ্যালাইটিস নয় । ওই গবেষণার পরে দেখা গেল অত্যধিক পরিমাণে লিচু খাওয়ার ফলে, খালি পেটে লিচু খাওয়ার ফলে এবং লিচু খেয়ে রাতের খাবার না খাওয়ায় যারা শিশু, গরিব পরিবারের সদস্য রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম এবং একটু রোগা পাতলা ধরনের তারা আক্রান্ত হয়েছিল ।
বিহারে এবার যে ঘটনা দেখা দিচ্ছে, তার সঙ্গে 2-3 বছর আগের ঘটনার প্রচুর মিল রয়েছে । এবার সত্যিই কোনও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে এনসেফ্যালাইটিস না কি লিচু গঠিত মেটাবলিক এনসেফ্যালোপ্যাথি, তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত বিস্তারিত কোনও সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়নি । স্বাভাবিক কারণেই যে প্রশ্ন সবার মধ্যে উঠে আসছে, তা হলে কি লিচু খাওয়া যাবে না? লিচু খেলেই কি এমন হতে পারে? না। নির্ভয়ে লিচু খান। লিচু খেলেই যে AES হবে তার কোনও মানে নেই । তবে, মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে লিচু খাবেন না । খালি পেটে লিচু খাবেন না । লিচু খাওয়ার পরে অন্ততপক্ষে ছোটোরা যেন রাতের খাবার খায় । তা হলে বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই । যে সব শিশুর শরীর-স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো, তাদের শরীরে জমা থাকা শর্করার পরিমাণও বেশ ভালো । এক্ষেত্রে তাদের শরীরে শর্করার পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা কম ।