পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

By

Published : Jul 21, 2019, 9:10 AM IST

ETV Bharat / state

ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে চিকিৎসা ? বিভাজনের অভিযোগ থেকে মুক্তির আশায় চিকিৎসকরা

চিকিৎসকদের বক্তব্য, প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে ৷

আলোচনা

কলকাতা, 21 জুলাই : চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে । এর মধ্যে যদি শীর্ষ প্রশাসন অবিশ্বাসের বাতাবরণ চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীদের সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়, তা হলে চিকিৎসকরা কী ভাবে কাজ করবেন? তাই, এমন বিভাজন, অস্থিরতার পরিস্থিতি থেকে কী ভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে, তার খোঁজ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের কাছে করলেন চিকিৎসকরা ।

এই চিকিৎসকরা অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গলের সদস্য । চিকিৎসকদের এই সংগঠনের তরফে গতকাল (শনিবার) NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় । আলোচনার বিষয় ছিল, "বিভেদের বিষে নড়ছে সমাজ/নগ্ন নিশানায় চিকিৎসা আজ" । NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের সাম্প্রতিক কর্মবিরতির সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় SSKM হাসপাতালে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, চিকিৎসকরা ধর্ম দেখে চিকিৎসা করেন । মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের জেরে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল ।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক মানস গুমটা বলেন, "যখনই কোনও বিতর্কিত বিষয় সামনে এসেছে, তখনই সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে ডেকে নিয়ে আমরা তাঁদের মতামত নিয়েছি । একটাই উদ্দেশ্য, সামনের দিনের চলার পথগুলিকে আমরা নির্ধারণ করে নিতে চাই ।"

একইসঙ্গে তিনি বলেন, "সাম্প্রতিক সময়ে, দেশজুড়ে বিভাজন, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা চলছে । মানুষ কী খাবেন, কী পরবেন, সবটার নিয়ন্ত্রক হয়ে যাচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র । গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ এমন বিভিন্ন মানুষকে আমরা দেখেছি তার শিকার হতে । সাম্প্রতিক সময়ে জাতের জন্য প্রিয়াঙ্কা নামে একজন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন । এগুলি আমাদের খুব ব্যথিত করে ।"

মুখ্যমন্ত্রীর নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, "সাম্প্রতিককালে NRS-এ পরিবহ মুখোপাধ্যায়ের উপরে ওইরকম একটা ভয়ংকর আক্রমণ, তাঁর আক্রান্ত হওয়া । এরপর আমাদের শীর্ষ প্রশাসনের তরফে যেভাবে একটি মন্তব্য করল, সেটা আমাদের স্তম্ভিত করেছিল । আমরা তো কোনওদিন ভাবিনি । চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকতে পারে । কিন্তু কোনও দিন এই অভিযোগ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে হয়নি যে ধর্ম, জাত বা ভাষা নিয়ে চিকিৎসায় প্রভাব আছে । আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম ।" তাঁর কথায়, "আমরা শুনতে চেয়েছিলাম, এমনিতেই তো চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের অভিযোগ হয়, তার মধ্যে যদি এরকম একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ আমাদের শীর্ষ প্রশাসন তৈরি করে দেয়, চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীদের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, তা হলে আমরা কাজ করব কী ভাবে?"

তিনি আরও বলেন, "আমাদের মূল লক্ষ্য, স্বাস্থ্যে জন্য এগিয়ে যাওয়া, সবার জন্য স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যের অধিকার ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য । এরকম ঘৃণা, বিভাজন বা অস্থিরতা নিয়ে কী ভাবে আমরা এরকম একটি সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাব? সেজন্যই আজকে আমাদের এই আয়োজন ছিল । আমরা শুনতে চেয়েছিলাম সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের কাছ থেকে যে, এসব কেন হচ্ছে এবং এর থেকে উত্তরণের পথ কী । এই নির্যাস নিয়েই আমাদের সংগঠন সামনের দিকে এগোবে । সেই আশা নিয়ে আমাদের আজকের এই আয়োজন ছিল ।"

গতকাল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন চিত্র পরিচালক অনীক দত্ত, শতরূপা সান্যাল, কবি আর্যতীর্থ, চিকিৎসক কাফিল খান‌ । রাষ্ট্র, রাজ্যের কাঠামো কেমন হওয়া উচিত, সে প্রসঙ্গে অনীকবাবু বলেন, "কোনও ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না । অনেক সময় বলা হয়, সেকুলার (ধর্মনিরপেক্ষ) হবে । আমার মনে হয়, এটা ন্যাকা ন্যাকা । এটা ইররিলিজিয়াস (অধার্মিক) হওয়া উচিত ।" এই ধরনের পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের তরফে প্রতিরোধের প্রয়োজন । একথা জানিয়ে তিনি বলেন, "আপনার বিশ্বাস বাড়িতে রাখুন । যখন আপনি পাবলিক প্লেসে আসবেন, তখন আপনি ইররিলিজিয়াস (অধার্মিক) ।"

শতরূপা বলেন, "যেটা স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল, সেটাকে আমরা অস্বাভাবিক বলে মনে করেছি । একজন দরিদ্র ট্যাক্সিচালক এক লাখ টাকা ফিরিয়ে দিলে খবর হয় । কেন? এটাই তো স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল । স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল মানবিকতা । দীর্ঘদিন সইতে সইতে ভুলে গেছি আমাদের একটি মেরুদণ্ড রয়েছে ।" ছোটোবেলা থেকে মানুষ হওয়ার শিক্ষার মধ্যেই রয়েছে বিভাজনের বিষ । একথা জানিয়ে তিনি বলেন, "ছোটোবেলায় শিখেছি সমাজবন্ধু কারা । চাষি, গোয়ালা, চিকিৎসক, শিক্ষক, উকিল,বিচারক, ব্যারিস্টার । চাষি, চাষিভাই । গোয়ালা, গোয়ালাভাই । জেলে, জেলেভাই । কিন্তু, শিক্ষক ভাই নয়, চিকিৎসক ভাই নয়, বিচারক ভাই নয়, ব্যারিস্টার ভাই নয়, উকিল ভাই নয় । এই যে শিক্ষা, গোড়া থেকেই আমাদের বিভাজন শিখিয়ে দেওয়া হয় । সমাজবন্ধুর ভিতরেও বিভাজন অর্থাৎ এরা কেউ ভগবান নয় ।" কাফিল খান বলেন, "ধর্ম, একটা বিশ্বাস । একজন চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা করতে আমি ভালোবাসি ।"

মেডিকেল কলেজে যখন থেকে পড়াশোনা শুরু হয়, তখন থেকে মেডিকেলে পড়ুয়াদের কাছে ধর্মের বিষয়টি কী ভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, সেই বিষয়ে আলোকপাত করেন কবি আর্যতীর্থ । তিনি প্রশ্ন তোলেন, "চিকিৎসকরা কী ভাবে ধর্মের ভিত্তিতে চিকিৎসা করবেন ? কোনও অঙ্গ কি ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন মানুষের শরীরে বিভিন্ন রকমের হয়?"

ABOUT THE AUTHOR

...view details