পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

মেয়েকে বাঁচাতে কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম, দাবি মায়ের

"সবাই বলে ভেলোরে ভালো চিকিৎসা হয়। আমার একটি কিডনি বিক্রি করে মেয়েকে ভেলোরে নিয়ে গিয়ে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব পরীক্ষা করে সুস্থ করার কথা ভেবেছিলাম। কিডনি বিক্রির জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম।" এই দাবি করেন অপরূপার মা অর্পিতা বিশ্বাস।

অপরূপা বিশ্বাস

By

Published : Apr 2, 2019, 10:45 AM IST

Updated : Apr 2, 2019, 2:09 PM IST

কলকাতা, 2 এপ্রিল: NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন কিশোরী মানসিক রোগে আক্রান্ত। তার চিকিৎসার প্রয়োজন। বাবা-মা আর্থিক কারণে সেই সময় তার চিকিৎসা করাতে পারেননি। কিন্তু দিন দিন কিশোরীর জেদ বাড়ছিল। বাড়ি থেকে টাকা চুরি করতে শুরু করেছিল সে। মেয়েকে সুস্থ করতে মা নিজের কিডনি পর্যন্ত বেচে ভেলোরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। গত 25 মার্চ স্কুলে সরস্বতী পুজোর খাওয়া দাওয়া ছিল। মা-বাবা নিষেধ করার পরও স্কুলে গিয়েছিল ওই কিশোরী। স্কুলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। তাকে বাড়ি নিয়ে এলে দেখা যায়, তার নাক থেকে আঠা জাতীয় কিছু গড়িয়ে পড়ছে। স্কুলের ব্যাগ থেকে ডেনড্রাইটের প্যাকেটও পাওয়া যায়। অনুমান কিশোরী ডেনড্রাইটের নেশা করত। গত 26 মার্চ ওই কিশোরীকে অসুস্থ অবস্থায় শক্তিনগর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

কিশোরীর নাম অপরূপা বিশ্বাস। বাড়ি নদিয়ায়। গতবছর 31 জুলাই NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ENT বিভাগের চিকিৎসকরা প্রথম দফায় ওই কিশোরীর গলা থেকে 9টি সুচ বের করেছিলেন। কিন্তু X-RAY রিপোর্টে 10টি সুচ দেখা গিয়েছিল। এরপর 7 অগাস্ট দ্বিতীয় দফায় অস্ত্রোপচার করে 10 নম্বর সুচটি বের করেছিলেন। তখনই অবশ্য চিকিৎসকরা অপরূপার বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন অপরূপার মানসিক সমস্যার কথা। সেইসঙ্গে এই মানসিক সমস্যার সঠিক সময় চিকিৎসা যদি না হয় তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন চিকিৎসকরা। আর্থিক সমস্যার কারণে সেই সময় NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগে ওই কিশোরীর চিকিৎসা করাতে পারেননি তার বাবা-মা।


মনোজ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসকদের একটি দল ওই কিশোরীর গলা থেকে 10টি সুচ বের করেছিলেন। তিনি কিশোরীর মৃত্যুর খবর পেয়ে বলেন, "অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আমরা মেজর অপারেশন করেছিলাম। অপারেশনের পরে সুস্থও হয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু অন্য যে সমস্যাগুলি ছিল, তার জন্য ওই কিশোরীর বাড়ির লোক সহযোগিতা করলেন না। মানসিক সমস্যার চিকিৎসার জন্য ওই কিশোরীকে যাতে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তার জন্য তার মা-বাবাকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু কোনও সমস্যার কারণে, রোগীকে নিয়ে আসেননি তাঁরা।" এই বিষয়ে কিশোরীর মা অর্পিতা বিশ্বাসের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "আর্থিক সসস্যার কারণে আমরা আর কলকাতায় গিয়ে সেই সময় চিকিৎসা করাতে পারিনি। তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, তার মেয়ের মানসিক চিকিৎসা করানো যে কতটা প্রয়োজন তা তিনি বুঝতেও পারেননি। তিনি আরও বলেন,"সবাই বলে ভেলোরে ভালো চিকিৎসা হয়। আমার একটি কিডনি বিক্রি করে মেয়েকে ভেলোরে নিয়ে গিয়ে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব পরীক্ষা করে সুস্থ করার কথা ভেবেছিলাম। কিডনি বিক্রির জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। NRS-এর চিকিৎসক বলেছিলেন আমি যেন বেআইনি এই কাজ না করি। এর পরে আমি আর এগোয়নি।"

কিন্তু কী করে 10টি সুচ কিশোরীর গলায় পৌঁছালো?

10টি সুচ কীভাবে ওই কিশোরীর গলায় আটকে গিয়েছিল তা অবশ্য জানতে পারেননি চিকিৎসকরা। তবে সুচগুলির অবস্থান দেখে চিকিৎসকদের অবশ্য অনুমান, চামড়া ফুটো করে বাইরে থেকেই ওগুলো ঢোকানো হয়েছিল। এই বিষয়ে কিশোরীর মা অর্পিতা এবং বাবা অধীর বিশ্বাসও স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাননি।

তবে এই ঘটনায় নড়েচড়ে বসে রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশন। ওই কিশোরীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করেছিল কমিশন। সোশাল অডিটের ব্যবস্থাও করেছিল।রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের প্রসূন ভৌমিক বলেন, "সোশাল অডিটে যে অভিযোগগুলি পাওয়া গিয়েছিল, সে সব খতিয়ে দেখা হয়েছে। কেন মৃত্যু হল, এই বিষয়ে রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশন‌ প্রশাসনের কাছে জানতে চাইবে।"

কোন ধরনের মানসিক সমস্যা ছিল অপরূপার?

NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের প্রধান আশিস মুখোপাধ্যায়কে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

হঠাৎ কেন আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল অপরূপা?

অর্পিতা বিশ্বাস বলেন, "মেয়ের উচ্চ রক্তচাপ ছিল। ওষুধ খেত। শ্বাসকষ্টও হত। হার্টের অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। দিনদিন তার জেদ বেড়ে যাচ্ছিল। কোনও কথা শুনত না। সোমবার 25 মার্চ স্কুলে সরস্বতী পুজোর খাওয়া-দাওয়া ছিল। স্কুলে যেতে বারণ করেছিলাম। আমাদের কথা শোনেনি। কিন্তু স্কুলে পৌঁছানোর ঘণ্টা দেড়েক পর স্কুল থেকে ফোন আসে। স্কুলে গিয়ে দেখি বেঞ্চে শুয়ে রয়েছে। খুব ঘামছে। বাড়িতে নিয়ে এসে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খাওয়াই। স্নান করানোর সময় দেখি ওর নাক দিয়ে আঠার মতো কিছু বের হচ্ছে। পরে স্কুলব্যাগ থেকে একটি আঠার প্যাকেট পাই। ডেনড্রাইট। কিন্তু স্কুলব্যাগে ডেনড্রাইট কেন জানতে চাইলে কোনও উত্তর দেয়নি ও।" পরে অবশ্য তিনি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানতে পারেন, এই আঠা নেশা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। মঙ্গলবারও স্নানের সময় ওই কিশোরীর নাক দিয়ে আঠা গড়িয়ে পড়তে দেখেন তিনি। অর্পিতা বিশ্বাস বলেন, "আমি জানতে চাই কোনও সমস্যা হচ্ছে? ও বলে কোনও সমস্যা হচ্ছে না, একটু ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে। দুপুরেও প্রেসার মাপি। অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না বুঝে শক্তিনগর হাসপাতালে নিয়ে যাই।" হাসপাতাল পৌঁছানোর পর চিকিৎসকরা জানান ওই কিশোরী আর বেঁচে নেই। কিন্তু মেয়ে যে বেঁচে নেই বিষয়টা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি অর্পিতা। তাই স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে তাঁরা নিয়ে যান ওই কিশোরীকে। কিন্তু তিনি না থাকায় ফের শক্তিনগর হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ওই কিশোরীর দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।

কেন মৃত্যু হল? কী বললেন চিকিৎসকরা?

অর্পিতা বিশ্বাস বলেন, "কেন মৃত্যু হল, চিকিৎসকরা কিছু বলেননি।"

অর্পিতা আরও বলেন, "বছর খানেক আগে মেয়ের কানে ব্যথা হয়েছিল। ওষুধে ব্যথা কমছিল না। কান পরিষ্কার করতে গিয়ে চোখে পড়ে সাইকেলের চাকায় থাকা ছোটো বল তার কানে ঢুকে রয়েছে। কানের কাছে চুম্বক ধরার পরে বেরিয়ে আসে বলটি।চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতে পরিমাণ মতো খাবার দিতাম। দিন দিন জেদ বেড়ে যাচ্ছিল। ক্লাস নাইনে ওঠার পরে বলল নতুন বই ছাড়া পড়বে না। ধার- দেনা করে নতুন বই কিনে দেওয়া হয়।"

Last Updated : Apr 2, 2019, 2:09 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details