শান্তিনিকেতন, 19 জুন : গোল লাইট হাউজ়ের আদলে তৈরি বাড়ি ৷ আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির মতো নয় ৷ বাড়িটিতে তাপবিদ্যুৎ নেই ৷ চারপাশে অদ্ভুত রকমের যন্ত্র ৷ কোথাও থ্রিডি প্রিন্টার সাইকেল ৷ যার নামও মনে হয় কেউ শোনেননি ৷ রয়েছে ভৌমজল উত্তোলনের ব্যবস্থাও ৷ বাড়ির ঠিকানা শান্তিনিকেতনের উত্তরপল্লি ৷ মালিক অরণি চক্রবর্তী ৷ পেশা অধ্যাপনা ৷ নেশা বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করা ৷ উদ্দেশ্য দূষণমুক্ত পরিবেশ ও খরচ কমানো ৷ কাজে লাগাচ্ছেন সৌরশক্তিকে ৷ তাপবিদ্যুৎ ছাড়া সোলার প্যানেলের মাধ্যমে জ্বলছে লাইট ৷ চার্জ হচ্ছে মোবাইল ৷
বিজ্ঞানকে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করে স্বল্প ব্যয়ে ও দূষণমুক্ত ভাবে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে 25 বছর ধরে গবেষণা করে চলেছেন বিজ্ঞানী অরণি চক্রবর্তী । 25 বছর ধরে তাঁর বাড়িতে আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির মতো নেই তাপবিদ্যুৎ। সৌরশক্তি দিয়েই সমস্ত যন্ত্রাংশ চালিত হয় । বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ ছাড়াই ভৌম জল উত্তোলন থেকে শুরু করে প্রাচীন রোমান কায়দা ব্যবহার করে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রও তৈরি করেছেন এই বিজ্ঞানী । বর্তমানে সৌরশক্তি দ্বারা চালিত ইঞ্জিন ও নিজেই নিজের চিকিৎসা করা যাবে এমন সফটওয়্যার তৈরিতে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন বিশ্বভারতীর পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বিজ্ঞানী অরণি চক্রবর্তী ।
অরণিবাবুর তৈরি করা অত্যাধুনিক সাইকেল বিশ্বভারতীর পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অরণি চক্রবর্তী । 1997 সাল থেকে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন । তাঁর নিজের তৈরি এক অন্য ধরনের সাইকেল নিয়ে তাঁকে অনেকেই চলাফেরা করতে দেখেন । ভিন্ন ধরনের সাইকেল হওয়ায় তিনি বোলপুর-শান্তিনিকেতনের মানুষের কাছে খুবই পরিচিত মুখ । কলকাতা বয়েজ স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন । তারপর বিশ্বভারতীতে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন । শান্তিনিকেতনের উত্তরপল্লিতে সস্ত্রীক বসবাস করেন বিজ্ঞানী অরণি চক্রবর্তী । তাঁর স্ত্রী সমিতা শীল সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপিকা ছিলেন । বর্তমানে তিনিও তাঁর স্বামীর সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত ।
গোল লাইট হাউজ়ের আদলে তৈরি অরণিবাবুর বাড়ি যেন গবেষণাগার
চুম্বকত্ব, স্পিন গ্লাস, সৌরশক্তির দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন, সফটওয়্যার তৈরি-সহ মেটা ফিজিক্সের উপর অরণিবাবুর সমস্ত গবেষণা । তাঁর নিজের নকশা করা সোলার প্যানেলের দ্বারা লাইট, ফ্যান-সহ, মোবাইল চার্জ হওয়া, কম্পিউটার প্রভৃতি চালিত হয় । বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ ছাড়াই ভৌম জল উত্তোলনের যন্ত্রাংশ তৈরি করেছেন তিনি । পায়ে করে সেই যন্ত্রে পাম্প করলেই মাটির তলা থেকে জল উঠে আসে । এছাড়া, তিনি তৈরি করেছেন 'গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জিং সিস্টেম ৷' এটি হল, বৃষ্টির জল ফিল্টার হয়ে পুনরায় মাটির নিচে জল প্রবেশ করানোর পদ্ধতি । এটিও বিদ্যুৎ ছাড়াই তৈরি করা । বাড়ির মধ্যে একটি পুকুর রয়েছে । সেই পুকুরের চারকোণে চারটি কুয়ো আছে । মাটির নিচের জলস্তর পর্যন্ত কুয়োর মধ্যে বড় চারটি পাইপ রয়েছে । সেই পাইপ দিয়ে বৃষ্টির জল পরিস্রুত হয়ে পুনরায় ভূগর্ভে প্রবেশ করে ।
আরও পড়ুন,ECL coal mines : রক্ষা মিলেছে বরাতজোরে, বেআইনি খনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কী, উত্তর অধরাই
বর্তমানে সকলেই বাজারজাত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন । কিন্তু, বিজ্ঞানী অরণিবাবুর বাড়িতে রয়েছে এক অদ্ভুত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র । বাড়ির বাইরে বেশ কয়েকটি পাইপ মাটির নিচে চলে গিয়েছে । তার কাছ থেকে জানা গিয়েছে, সেই পাইপের মুখ দিয়ে বাতাস প্রবেশ করে । সেই বাতাস পুকুরের নিচে থাকা পাইপ দিয়ে এসে একটি বড় পাইপের সঙ্গে যুক্ত হয় । সেই বড় পাইপ দিয়ে বাড়ির ভিতরে শীতল বাতাস প্রবেশ করে । এভাবেই বাইরের তাপমাত্রা থেকে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা অনেক কম থাকে । এই পদ্ধতি প্রথম রোমানরা ব্যবহার করেছিল । রোমের সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ছাড়াই অরণিবাবুর বাড়ি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত । এছাড়াও বাড়ির ভিতরে একাধিক ছোটখাটো যন্ত্রাংশ তিনি নিজেই বানিয়ে নিয়েছেন । যেমন, তাঁর অ্যাসেম্বল করা কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবস্থা, থ্রিডি প্রিন্টার আরামদায়ক সাইকেল প্রভৃতি ।
ভৌম জল উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বর্তমানে তিনি একটি সফটওয়্যার বানানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন । এই সফটওয়্যার বানাতে তাঁকে সহযোগিতা করছেন তাঁর স্ত্রী অধ্যাপিকা সমিতা শীল । সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে মানুষ নিজের চিকিৎসার নিজেই করতে পারবেন । হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চলেছেন সস্ত্রীক বিজ্ঞানী অরণিবাবু । তাঁর কাছ থেকেই জানা গিয়েছে, এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিজের অসুখের বিভিন্ন সমস্যার কথা জানালে, সফটওয়্যার বিভিন্ন পরামর্শ দেবে । এমনকি, কী ওষুধ ব্যবহার করতে হবে তারও পরামর্শ দেবে । অরণিবাবুর বিশ্বাস, পরবর্তীকালে এই সফটওয়্যার চিকিৎসকদেরও খুব কাজে লাগবে । দীর্ঘ চার বছর ধরে এই সফটওয়্যার তৈরির কাজ করছেন তিনি ।
সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দূষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন অরণিবাবুর আরও পড়ুন,ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগ, ধ্বংসের মুখে রায়পুর রাজবাড়ি
পাশাপাশি, সৌরশক্তির দ্বারা চালিত স্বল্প ব্যয়ে ইঞ্জিন তৈরি নিয়েও গবেষণা করে চলেছেন । এছাড়াও, তাঁর স্বপ্ন পশুপালন করে উৎপাদিত মাংসের বদলে কৃত্রিমভাবে মাংস তৈরি করা । যাকে বলে 'আর্টিফিশিয়াল মিট'। স্বাদ একই রেখে কৃত্রিম মাংস তৈরি করতে চান তিনি । তাঁর ধারণা, এই ধরনের জিনিস তৈরি ও ব্যবহারের ফলে দুটো দিকে আগামী প্রজন্ম উপকৃত হবে । তা হল- এক, খরচ বহু অংশে কমবে। দুই, দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ে উঠবে । এই সবকিছুর ফাঁকে মাঝেমধ্যে বেহালাও বাজান তিনি ।
অরণিবাবু বলেন, "অধ্যাপনা করি ৷ পাশাপাশি বিজ্ঞান চর্চা ও তা নিয়ে নাড়া-ঘাটা করা আমার একটা স্বভাব। হঠাৎ হঠাৎ ভাবনা আসে, সেই ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে যেটা ইচ্ছে বানাতে শুরু করি। এই ধরনের জিনিসগুলো একদিকে যেমন কম খরচ, অন্যদিকে দূষণ হয় না । তাছাড়া, বারবার কারেন্ট যাওয়ারও কোনও ব্যাপার থাকে না ৷ এগুলো ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপনও করা যায়। ভবিষ্যতে আরও ভাবনা আছে । সফটওয়্যার তৈরি, সোলার ইঞ্জিন, আর্টিফিশিয়াল মিট তৈরি করার। তবে তা সম্ভব হবে কি না জানি না ৷ তবে ইচ্ছা সম্পূর্ণভাবে রয়েছে ৷ "
এককথায় বিজ্ঞানী অরণি চক্রবর্তীর বাড়ি এক গবেষণাগার । অভূতপূর্ব বিজ্ঞান সাধনায় 25 বছর ধরে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছেন তিনি । ভাবনাগুলিও সম্পূর্ণ ভিন্ন ও জনহিতকারী । যা অন্যদের প্রেরণা জোগাবে ৷