বাঁকুড়া, 11 অগস্ট : বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ভুয়ো নথি দিয়ে সিম তোলা ও সেই সিমের ভিত্তিতে ই-ওয়ালেট তৈরি করা হয়েছে ৷ তারপর দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সাইবার প্রতারকদের কাছে তা বিক্রি করার বড়সড় চক্রের পর্দাফাঁস হল বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে । এই ঘটনায় ভুয়ো নথির ভিত্তিতে তোলা প্রায় 9 হাজার সিম কার্ড, 10 হাজারের বেশি ই-ওয়ালেট-সহ বিভিন্ন সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ । এই ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে এখনও পর্যন্ত 6 জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে । এই ঘটনায় জামতাড়া গ্যাংয়ের যোগাযোগ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে ৷ এই খবরের পর সাংবাদিক বৈঠক করেন বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার ৷ সেখানে তিনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেন কী ভাবে প্রতারণা চক্র কাজ করত ৷
ভুয়ো সিম তৈরি
- অনলাইনে টেলিগ্রাম নামক সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপের মাধ্যমে কাস্টমারের সঙ্গে যোগাযোগ করত অভিযুক্তরা ৷
- ডিঅ্যাকটিভেটেড ফেক সিম জোগাড় করত তারা ৷ যেখানে নাম, ঠিকানা, আধার কার্ড, সিআইড ফর্ম (Customer Identification form) ভুলভাল থাকে ৷
- গ্রেফতার হওয়া 6 জনের মধ্যে কোতুলপুর এলাকার রামপ্রসাদ দিগর বিভিন্ন সার্ভিস প্রোভাইডারদের ভুয়ো ক্যাফ বা কাস্টমার অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম (Customer Application Form) তৈরি করত ৷
- ওদের ভোটার আইডিকার্ড, আধার কার্ড দিয়ে তাতে অন্য কারও নাম যুক্ত করে আর থার্ড পার্টি কারও ছবি দেওয়া হত ৷ পুলিশ সুপারের কথায়, "যদি কোনও ইনভেস্টিগেশন আসে, তাহলে এটা ধরা বাস্তবে রীতিমতো অসম্ভব ৷"
- বাজেয়াপ্ত করা হার্ড ডিক্স থেকে 5 হাজারেরও বেশি ভুয়ো নথি পাওয়া গিয়েছে ৷
বাঁকুড়ায় উদ্ধার হওয়া ভুয়ো সিম, মোবাইল
ভুয়ো সিম দেশে ছড়িয়ে দেওয়া
- গ্রেফতার হওয়া আরেক অভিযুক্ত রাজারাম বিশ্বাস একটি টেলিকম সংস্থার ডিলার ৷ রামপ্রসাদের তৈরি করা ফেক সিমগুলো জোগাড় করত রাজারাম ৷ সে বিভিন্ন জায়গায় বিপুল পরিমাণে এই ভুয়ো সিমগুলো বিক্রি করত ৷
- এই ভুয়ো সিম ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোহিত মণ্ডল ৷ গ্রেফতার হওয়া রোহিত রাজারামের কাছ থেকে এই সিমগুলো কিনত ৷ সেগুলো পাঠাত অভিষেক মণ্ডল আর তার ভাই অভিজিৎ মণ্ডলকে ৷ তাদের বাড়ি ধবগ্রামে ৷
এখনও পর্যন্ত 8282 টি সিম উদ্ধার করা হয়েছে ৷ অভিজিৎ মণ্ডলের বাড়ি থেকে 7 টি পাশবুক পাওয়া গিয়েছে ৷ 15টিরও বেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পাওয়া গিয়েছে ৷ 23 মোবাইল ফোন, 1টি ল্যাপটপ, 2টি সিপিইউ, 1টি হ্যান্ডিক্যাম, 1টি রাউটার, 125টি রঙিন ছবি ৷ আর বেশ কিছু অপরিচিত মানুষের প্যান কার্ড ও তার জেরক্স ৷ এই চক্রের পাণ্ডা বা মাস্টারমাইন্ড অভিষেক মণ্ডল ৷ ফেক সিম থেকে ই-ওয়ালেট জেনারেট করত দু'ভাই ৷
আরও পড়ুন : Illegal call centers : শহরে বাড়ছে অবৈধ কলসেন্টার, জালিয়াতদের ফাঁদে বেকার যুবক-যুবতীরা
ভুয়ো সিম থেকে ই-ওয়ালেট জেনারেটের পদ্ধতি
- অনলাইনে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা প্রতারণা করলে তা সাধারণত অন্য কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢোকে ৷ এই সন্ধান পেলে পুলিশ চিঠি দিয়ে সেই অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড করে দেয় ৷ তাই বিকল্প ই-ওয়ালেট ৷ প্রতারণার পর সেই টাকা ঢুকতে পারে ই-ওয়ালেটে ৷ এখানে টাকার ঢোকার পদ্ধতি জটিল হলেও তা সম্ভব ৷ তাই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের প্রতারিত টাকা কোনও ই-ওয়ালেটে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তা প্রতারকদের কাছে তুলনায় সুবিধেজনক ৷
- অভিষেক ও তার ভাই অভিজিৎ মণ্ডল ই-ওয়ালেটটাকে বিক্রি করে দিচ্ছে সারা দেশে ৷
- 6টি টেলিগ্রাম চ্যানেলে সারাদিন ধরে বার বার "এখুনি ওটিপি দাও" বলে মেসেজ আসে ৷ ওটিপি চাওয়া মানে আগেও ফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে ৷ সেই নম্বরে ওটিপি চাইছে ই-ওয়ালেট জেনারেট করার জন্য ৷ ওটিপি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বিনিময়ে পাচ্ছে টাকা ৷ এই টাকা আসছে ফোনপে, অ্যামাজন পে-র মতো বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়ে দিয়ে ৷
- এই ভাবে ই-ওয়ালেটে টাকা চলে যাচ্ছে ৷ ওয়ালেট থেকে টাকা এনক্যাশ হচ্ছে কোনও ব্যাঙ্ক লিঙ্কের মাধ্যমে অথবা সেই ওয়ালেট থেকে অ্যামাজন গোল্ড কেনা হচ্ছে ৷ এটা কিনতে পারা যায় ৷ কেনার কিছুদিন পর মার্কেটে সোনার দাম ওঠা-পড়া দেখে সেটা এনক্যাশ করছে অভিযুক্তরা ৷
ই-ওয়ালেট থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি
- অভিষেক ও অভিজিৎ মণ্ডল পেমেন্ট গেটওয়ের এই টাকা দিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনছে ৷ তিনটে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনেছে তারা ৷ মোবাইল ফরেনসিকে গেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে, জানিয়েছেন পুলিশ সুপার ৷
- ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিময়ের পদ্ধতি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মতো নয় ৷
- এর ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে না রেখে ক্রিপ্টোকারেন্সির অ্যাকাউন্টে রেখে দিয়েছে অভিযুক্তরা ৷ তবে এই অর্থের পরিমাণ জানতে গেলে ক্রিপ্টোকারেন্সির ওয়ালেট অবধি কী ভাবে পৌঁছাতে হবে, সেটা জানা জরুরি ৷
কারা কিনছে ই-ওয়ালেট
- প্রধানত অনলাইন প্রতারকরা এই ই-ওয়ালেট কিনছে ৷ যারা নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে প্রতারণা চালায় ৷
- দুটো ফোন ব্যবহার করা হচ্ছে ৷ একটা থেকে প্রতারণা করার জন্য কোনও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে ৷ আরেকটা ফোনে টাকা রাখার হদিশ থাকছে ৷ এতে দুটো বিষয়ের মধ্যে লিঙ্ক থাকছে না ৷
আরেকটি পদ্ধতি ফেক লাইক, ফেক শেয়ার
- কেউ সোশ্য়াল মিডিয়ায় তার কনটেন্ট দিলে, সাধারণত প্রচুর সংখ্যায় সাবস্ক্রাইবার চায় ৷
- সাবস্ক্রাইব হলে বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় ৷
- অভিযুক্তরা ফেক আইডি, ফেক জিমেল অ্যাকাউন্ট তৈরি করে এখানে লাইক, শেয়ার দিয়ে নম্বরের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করে ৷
বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এ ধরনের হাই-টেক প্রতারণায় অবাক হয়েছেন পুলিশ সুপার ধৃতিমান সরকার ৷ অভিযুক্ত অভিষেক মণ্ডল বাংলা ভাষায় বিএ পড়ছিল, তারপর একসময় পড়া ছেড়ে দেয় ৷ বয়স আনুমানিক 24 বছর ৷ গ্রামে বসে কী ভাবে সে এই ধরনের অনলাইনে প্রতারণার কাজ রপ্ত করল, তা নিয়েও তদন্ত হবে ৷ অনুমান কোনও প্রতারণা চক্রের কাছ থেকেই এ কাজ শিখেছে ধবগ্রামের বাসিন্দা অভিষেক ৷ তদন্তে জানা গিয়েছে, গত 2 বছরেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় রয়েছে এই চক্রটি । এই পদ্ধতিতে আনুমানিক 40 থেকে 50 লক্ষ টাকা প্রতারণা করেছে তারা । এই চক্রের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের একাধিক বড় প্রতারক চক্রের যোগ রয়েছে বলেও জানতে পেরেছে পুলিশ ।