বাঁকুড়া, 1 সেপ্টেম্বর : বাঁকুড়া জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র শুশুনিয়া পাহাড় । এই পাহাড়ের কোলেই রয়েছে গোপীনাথ আশ্রম । এখানে পাথরের মূর্তিতে দুর্গাপুজো হয় । প্রতি বছরই পুজোর সময় পর্যটকদের ভিড় থাকে আশ্রমে । কিন্তু এবার ছবিটা অন্যরকম । কোরোনার আশঙ্কায় প্রায় ফাঁকা শুশুনিয়া ও গোপীনাথ বাবার আশ্রম । প্রায় 30 বছর ধরে এখানে পুজো হচ্ছে । কিন্তু কোনও বছর এমন ফাঁকা আশ্রম কেউ দেখেননি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা ।
বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় 30 কিলোমিটার দূরে শুশুনিয়া পাহাড় । ছাতনা থানার অন্তর্গত সবুজে ঘেরা শুশুনিয়া পাহাড় ও গ্রাম । প্রায় প্রতিদিন এখানে পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে । শরতের সময় এখানে প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে দেয় । একদিকে নীল আকাশ, অন্যদিকে পেজা তুলোর মতো মেঘ । নিচে সাদা কাশবনের রংয়ের ছটায় মুগ্ধ হয় ভ্রমণ প্রিয় মানুষ । দুর্গাপুজোর সময় প্রতিবছর অনেকে ভিড় করেন শুশুনিয়ায় । একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং আর একদিকে পাহাড়ের কোলে আশ্রমের দুর্গাপুজো পর্যটকদের মন কাড়ার জন্য যথেষ্ট । শুধু জেলা নয়, পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি থেকেও অনেকেই এখানে এসে থাকেন ।
আশ্রমে দুর্গাপুজো হয় বৈষ্ণব মতে । অর্থাৎ এখানে বলি হয় না । নবমীর দিন কুমারী পুজোর প্রচলন আছে । এছাড়াও পুজোর দিনগুলিতে কয়েক হাজার মানুষ এখানে অন্নভোগ পায় । সারা বছর পর্যটকরা এই মন্দিরে এসে যে দান দিয়ে থাকেন সেই অর্থ দিয়ে পুজো হয় । শুশুনিয়া গ্রাম এবং পাহাড়ের ব্যবসায়ীরা চাঁদা দেন মন্দিরের পুজোর জন্য । তবে এবছর ছবিটা একেবারেই আলাদা । গত প্রায় ছ'মাস ধরে কোরোনা সংক্রমণের জেরে পর্যটক আসা এক প্রকার বন্ধ হয়ে গিয়েছে শুশুনিয়ায় । ফলে মন্দিরের প্রণামী বাক্স খালি পড়ে রয়েছে । পর্যটক না আসায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়েছেন । তাই অন্যান্য বছরের মতো তাদের পক্ষেও আর্থিক সহযোগিতা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে । এই অবস্থায় পুজোর আয়োজন কীভাবে করা হবে তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে আশ্রম কর্তৃপক্ষ । যদিও স্থানীয়দের অনেকেই মনে করেন কোরোনার আতঙ্ক কিছুটা হলেও মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে দূর হচ্ছে । ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে গেলে হয়তো চিত্রটা আলাদা হতে পারত । তবে পুজোর ক্ষেত্রে যে আর্থিক অনটন থেকে যাবে তা স্বীকার করছেন সকলেই ।
এবার কার্যত ফাঁকা গোপীনাথ বাবার আশ্রম গোপীনাথ বাবার আশ্রমের দুর্গাপুজোর প্রচলনের পিছনে রয়েছে এক অন্য কাহিনি । আশির দশকে এই পাহাড়ে পুজোর সূচনা করেছিলেন জনৈক গোপীনাথ চক্রবর্তী । তিনি বজবজের বাসিন্দা । সেখানে একটি জুট মিলে চাকরি করতেন । ঘর সংসার করেননি । একদিন হঠাৎ চাকরি ছেড়ে ঈশ্বরের সাধনা করতে শুশুনিয়া পাহাড়ে পৌঁছে যান তিনি । পাহাড়ের কোলে সেই সময় একচিলতে খড়ের চালের মধ্যে ছিল একটি কালী মন্দির । সেই কালী মন্দিরে আশ্রয় নেন গোপীনাথ চক্রবর্তী । তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক সহকর্মী । বর্তমানে সেই সুবোধ চৈতন্য ব্রহ্মচারী এই আশ্রমের মহারাজ । তাঁর বাড়ি ছিল হাওড়ার বাগনানে । পাহাড়ের কোলে এই কালী মন্দিরে বছর কয়েক কাটানোর পর একদিন দৈবাদেশ পান গোপীনাথ চক্রবর্তী । তিনি সিদ্ধান্ত নেন, দুর্গাপুজো করবেন । সেই থেকেই শুশুনিয়ার কোলে দুর্গাপুজোর প্রচলন । প্রথমদিকে অস্থায়ী ছাউনি তৈরি করে পুজো হত । পরে ভক্ত সমাগম বাড়তে থাকে । সঙ্গে আশ্রমেরও আয় বাড়তে থাকে । সেই অর্থ দিয়ে ধীরে ধীরে মন্দির তৈরি হয় । মন্দিরে স্থায়ী পাষাণ মূর্তি তৈরি করা হয় দেবী দুর্গার । 1410 বঙ্গাব্দে মৃত্যু হয় গোপীনাথ চক্রবর্তীর । তাঁর পরে আশ্রমের ভার বর্তায় সুবোধ চৈতন্য ব্রহ্মচারীর উপর । বর্তমানে তিনি এই আশ্রমের মহারাজ এবং আশ্রমের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করেন ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে মনে করছেন, পুজো করতে চাইলে অর্থের অভাব কোনও সমস্যা নয় । আবার অনেকে মনে করছেন, বছরের এই কয়েকটা দিন যা আনন্দ হয় এবছর তাও হয়তো হবে না । লকডাউনের ফলে আয় বন্ধ । যেটুকু আশা ছিল দুর্গাপুজো ঘিরে তাও এবছর হবে কি না জানা নেই । আশ্রমে বসে পুণ্যার্থী থেকে পর্যটকদের পথের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন মহারাজ । অপেক্ষায় থাকে শুশুনিয়া ।