কলকাতা, 4 এপ্রিল: ক্ষুধার রাজ্যে তার পৃথিবীটা সত্যি গদ্যময়। রাজেশ মাঝি। বাংলার জুডোয় অন্যতম সম্ভাবনাময় মুখ। অভাব-অনটন নিত্য সঙ্গী। কিন্তু বছর আঠারোর কিশোর রাজেশের ইচ্ছে শক্তির সামনে অভাব হার মেনেছে।
আলুসেদ্ধ, ভাতের মধ্যে লুকিয়ে রাজেশের জুডোর স্বপ্ন
গরিবির কাছে হার মানেনি স্বপ্ন। অভাব অনটন নিত্য সঙ্গী হয়েও জুডোর স্বপ্নে বিভোর বছর আঠারোর রাজেশ মাঝি। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে দাঁতে দাঁত চেপে। জুডো খেলায় বাংলার নতুন সম্ভাবনাময় মুখ রাজেশ।
রাজেশের বাবা সুবোধ মাঝি। মা সরস্বতী মাঝি। তিনটে মানুষের সংসারটা স্বচ্ছল নয় মোটেই। ভোর থাকতে সুবোধবাবু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। চটকলে শ্রমিকের কাজে দিন গুজরানের দায়িত্ব। সকাল থেকেই বাড়ি বাড়ি দৌড়ে বেড়াতে হয় সরস্বতীকে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসারে বাড়তি কিছু অর্থের জোগানই লক্ষ্য। সুবোধ ও সরস্বতীর ছেলে রাজেশ একটু অন্যভাবে জীবনকে গড়তে চায়। বাবা মায়ের কঠিন লড়াই তার নিজের লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জোগায়। সুবোধ জানেন, রাজেশ ঠিকভাবে দাঁড়ালে সংসারের হাল ঘুরতে পারে। চটকলের কাজে লাগিয়ে দিলেই হয়। কিন্তু বাবা হিসেবে ছেলেকে এই কষ্টের পরিবেশে নিয়ে আসতে মন চায় না। তাই রাজেশের পড়াশোনায় উৎসাহ দেন তিনি। পাড়ার এক দাদা এসে সরস্বতীকে বলেছিল রাজেশকে জুডোয় ভরতি করে দিতে। পড়াশোনার সাথে খেলাটা থাকলে চাকরি-বাকরি পেতে সুবিধা হবে। রাজেশের মায়ের মুখে প্রথমে প্রস্তাব শুনে ভয় পেয়েছিলেন সুবোধ। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থার মাঝে খেলার ঝক্কি। তাই মন সায় দেয়নি। তাছাড়া চোট লাগার আশঙ্কা। তারপর কিছুটা নিমরাজি হয়েই রাজেশকে জুডো খেলার অনুমতি দিয়েছিলেন। এখন যখন রাজেশ ট্রফি হাতে কিংবা মেডেল ঝুলিয়ে ঘরে ঢোকে চোখটা অজান্তে জলে ভরে যায় সুবোধের। আনন্দাশ্রু।
বাবার হাসি, মায়ের গর্বিত মুখ রাজেশকে স্বপ্ন দেখায়। আলুসেদ্ধ ভাতেই স্বপ্ন দেখে সে। টিভিতে একদিন কোনি সিনেমাটা দেখেছে। মনে হয়েছিল তার জীবনটাই দেখানো হচ্ছে। হুগলি বৈদ্যবাটির বনমালী মুখার্জি ইনস্টিটিউটের ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র রাজেশ। বাণিজ্য শাখায় পড়ার চাপ সামলে নতুনভাবে জীবন গড়ার লড়াই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য। কোনির মতো তার একজন খিদ্দা আছেন। গৌতম দাস। প্রাক্তন সেনা কর্মী এখন একটি সংস্থায় কাজ করেন। তবে তাঁর প্যাশন জুডো। 10 বছর বয়সে রাজেশ যখন তাঁর কাছে এসেছিল তখনই ভালো লেগেছিল। "অর্থ কষ্ট উপেক্ষা করে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের ইচ্ছেটাই রাজেশের প্লাস পয়েন্ট। ঝড় জল বৃষ্টি যাই হোক না কেন রাজেশ প্র্যাকটিস কামাই করে না। সত্যি গরিব ওরা। খাওয়ার পয়সা থাকে না। খেলার পোশাক তো বিলাসিতা। আমি টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছিলাম", বলছিলেন গৌতম দাস। "আপাতত গ্রিন বেল্ট পেয়েছে। পয়সা জোগাড় করতে না পারায় ব্লু এবং ব্রাউন বেল্টের পরীক্ষা দেওয়া হয়নি রাজেশের। মাত্র 500 টাকা দরকার ছিল। আমাকে লজ্জায় বলেনি। তাছাড়া প্রস্তুতিটাও ঠিক মতো হয়নি।" বললেন রাজেশের কোচ। আর্মিতে যোগ দিতে চায় রাজেশ। বলার সময় চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। পরিশ্রম করতে ভয় পায় না। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কঠোর পরিশ্রমে আপত্তি নেই। এশিয়ান গেমস কিংবা অলিম্পিকে নামার স্বপ্ন দেখে। আলুসেদ্ধ, ভাতের মধ্যে লুকিয়ে রাজেশ মাঝির স্বপ্ন।