হায়দরাবাদ, 1 অক্টোবর: অটো চালিয়ে ছেলেকে মানুষ করেছেন বাবা ৷ তাই ছেলে চাইতেন কখনও যদি ক্রিকেটার হতে পারেন তবে বাবা-মা'কে নির্ঝঞ্ঝাট, সুখী একটা জীবন উপহার দেবেন ৷ কঠোর অধ্যাবসায়কে সঙ্গী করে দেশের জার্সি গায়ে চাপালেও ছেলের সেই সাফল্যের সঙ্গী খুব বেশি হতে পারেননি স্পিডস্টার মহম্মদ সিরাজের বাবা ৷
গতি এবং লেংথ দিয়ে দেশের তরুণ ক্রিকেট অনুরাগীদের মুগ্ধ করছেন সিরাজ ৷ সম্প্রতি এশিয়া কাপ ফাইনালে তাঁর বিধ্বংসী স্পেলে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে শ্রীলঙ্কা ৷ কিন্তু হায়দরাবাদ পেসারের আক্ষেপ বাবা তাঁর সাফল্যের শরিক বিশেষ হতে পারলেন না ৷ এশিয়া কাপ ফাইনালে 15 রানে 6 উইকেট নেওয়া সিরাজ আক্ষেপের সুরে তাই বলেন, "বাবা কখনও আমাকে তাঁর শরীর অসুস্থতা নিয়ে জানায়নি ৷ 2021 আমি যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে তখন বাবা মারা যায় ৷"
2023 ঘরের মাটিতে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন অনেকাংশে আবর্তিত হচ্ছে মহম্মদ সিরাজকে ঘিরে ৷ খুব স্বল্প সময়েই সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতের পেস বিভাগের ভরসা হয়ে উঠেছেন হায়দরাবাদি পেসার ৷ যিনি আবার অনুরাগী মহলে পরিচিত 'মিঞাঁ ম্যাজিক' নামে ৷ যাঁর কেরিয়ারের নেপথ্য কাহিনী অনুপ্রাণিত করবে তরুণ প্রজন্মকে ৷
সিরাজের জাতীয় দলের তারা হয়ে ওঠার ভিত স্কুল ক্রিকেট ৷ সপ্তম শ্রেণিতে স্কুল ক্রিকেটে হাতেখড়ি হওয়া সিরাজ প্রথমে চেয়েছিলেন ব্যাটার হতে ৷ কিন্তু সময় তাঁকে বোলার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ৷ দশম শ্রেণির পর অর্থাভাবে আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি সিরাজ ৷ তখন বাড়ির কাছে একটি মাঠে টেনিস বলে নিয়মিত ম্যাচ খেলতেন আরসিবি পেসার ৷
ইঞ্জিনিয়ারিং পঠনরত দাদাকে দেখিয়ে মা তখন সিরাজকে বকতেন এবং বলতেন, "দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর তুই খেলে সময় কাটাচ্ছিস ৷" পালটা সিরাজ মা'কে বলতেন, বাবাই তাঁকে উৎসাহ জুগিয়েছে ৷ সব দেখেশুনে সিরাজের এক মামাকে সব ঘটনার কথা জানান মা ৷ যা শাপে বর হয় ভারতীয় ক্রিকেটারের জন্য ৷ সিরাজের মামা তাঁর ক্লাবে খেলার জন্য নিয়ে যান ভাগ্নেকে ৷ সেই ক্লাবের হয়ে প্রথম ম্যাচেই 9 উইকেট নেয় ছোট্ট সিরাজ ৷ জহুরির চোখ সোনা চিনতে ভুল করেনি ৷
সিরাজের মা'কে বুঝিয়ে ভাগ্নেকে গ্রেসবল (ডিউজ বল) টুর্নামেন্টের জন্য নিয়ে যান তাঁর মামা ৷ স্মৃতির সরণি বেয়ে সিরাজ জানিয়েছেন, 19 বছর বয়সে প্রথম ডিউজ বল প্রতিযোগিতায় 5 উইকেট নিয়ে নজর কাড়েন সিরাজ ৷ এরপর স্থানীয় একাধিক লিগ খেললেও সেভাবে উন্নতি নজরে আসছিল না ৷ এরইমধ্যে অনূর্ধ্ব-23 হায়দরাবাদ দলে সুযোগ পান তিনি ৷ সেখান থেকে 2016 আইপিএলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের নেট বোলার হিসেবে সুযোগ পেতেই বদলে যায় সিরাজের কেরিয়ারের চালচিত্র ৷
তৎকালীন আরসিবি বোলিং কোচ ভরত অরুণ নেটে সিরাজকে দেখে মুগ্ধ হন ৷ হায়দরাবাদের হয়ে রণজি খেলার সুযোগ পেয়ে যান সিরাজ ৷ সেই মরশুমেই ভরত অরুণ হায়দরাবাদ রণজি দলের কোচ হয়ে কিছুটা জোর করেই সিরাজকে স্কোয়াডে নেন ৷ কোচের ভরসার মান রাখেন ভারতীয় পেসার ৷ মরশুমে 45টি উইকেট নিয়ে উঠে আসেন পাদপ্রদীপের আলোয় ৷
আরও পড়ুন:পাঁচ কনিষ্ঠ ক্রিকেটার, যাঁরা পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন আসন্ন বিশ্বকাপে
2017 আইপিএল নিলামে 2.6 কোটি টাকায় প্রতিশ্রুতিমান সিরাজকে দলে নেয় সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ৷ সিরাজ জানান, সে সময় বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলেন তিনি ৷ বাড়ি ফিরে আইপিএলে দল পাওয়ার ব্যাপারে জানতে পারেন ৷ আইপিএলে সুযোগ পাওয়া কথা স্মরণ করে সিরাজ বলেন, "আমরা তখন ভাড়া বাড়িতে থাকতাম ৷ আইপিএলে সুযোগ পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই আমি নিজের বাড়ি কিনি ৷ জীবনে ভালো কিছু করেছি এই ভেবে সেদিন তৃপ্ত হয়েছিলাম ৷"
আইপিএলে প্রমাণ করে ওই বছরই জাতীয় টি-20 দলে ডাক পেয়েছিলেন সিরাজ ৷ আত্মপ্রকাশ সুখের না-হলেও 2018 আইপিএল নিলামে 'মিঞাঁ ম্যাজিক'কে দলে নেয় আরসিবি ৷ ওই বছর কোনও ম্যাচ খেলার সুযোগ না-পেলেও কোহলির দর্শন মুগ্ধ করেছিল সিরাজকে ৷ 2019 আরসিবি'র জার্সিতে অভিষেকের সুযোগ পেলেও সিরাজের পারফরম্যান্স যথেচ্ছ সমালোচিত হয় নেটমাধ্যমে ৷
এরপর 2020 লকডাউনে শুরু হয় সিরাজের ফিরে আসার লড়াই ৷ সেই সময় তাঁর কঠোর অধ্যাবসায়-অনুশাসন প্রতিফলিত হয় 2020 আইপিএলে ৷ ওই বছর কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে ম্যাচটাই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায় সিরাজের কেরিয়ারে ৷ নাইটদের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে তিন উইকেট নিয়েছিলেন হায়দরাবাদ পেসার ৷ এরপর 2020-21 অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ কখনও ভোলার নয় সিরাজের জন্য ৷ ওই সিরিজের পারফরম্যান্সকে সঙ্গী করেই ধীরে ধীরে জাতীয় দলের বৃত্তে জায়গা পাকাপাকি করেন সিরাজ ৷