আমার সঙ্গে ওঁর যেটুকু দেখা, তা হয় 2008 সালে । আমরা তার আগে বেশ কয়েক বছর ধরেই কাজ করছিলাম ভারতের ফুটবল জনপ্রিয় করার জন্য । তখনই আমাদের মাথায় একটি পরিকল্পনা আসে- যারা আন্তর্জাতিক ফুটবলের গুরুত্বপূর্ণ খোলোয়াড় তাঁদের নিয়ে এসে দেশের ফুটবলকে যদি জনপ্রিয় করা যায় । তারই একটি অংশ হিসেবে বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করার সময় সেবাস্টিয়ান এবং হেইনজ় নামে দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আমাদের । সেবাস্টিয়ান ওঁর খুবই কাছের লোক এবং হেইনজ়ের দাদা আর্জেন্তাইন ন্যাশনাল ফুটবল টিমে খেলতেন তখন ।
আমি, ভাস্বর গোস্বামী এবং মিস্টার পান্ডে সেবাস্টিয়ান এবং হেইনজ়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাই । প্রথমেই অবশ্য দেখা করতে পারিনি । ওঁর প্রাক্তন স্ত্রী ওঁর সঙ্গে 5 মিনিটের জন্য দেখা করার সুযোগ করে দেন । আমরা ওঁর বাড়ি যাই । উনি তখন বুয়েনস আইরেসের ফ্ল্যাট ছেড়ে ডাউনটাউনে একটি ছোট্ট চমৎকার বাড়ি করে চলে গিয়েছেন । সেখানেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম ।
উনি এলেন । আমাদের সামনে দু'হাত দূরে দিয়েগো মারাদোনা । আমরা খানিকটা জড়োসড়ো । কিন্তু তিনি এসে যেভাবে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন, মনে হল আমরা ওঁর কত আপন । তারপর সেই পাঁচ মিনিটের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বেড়ে দুঘণ্টার আড্ডায় পরিণত হল । ফুটবল, রাজনীতি, সমাজনীতি সমস্ত কিছু নিয়েই চলল আলোচনা । তখন মনে হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে, না কলেজের সিঁড়িতে, নাকি কলকাতার কোনও রকে বসে আড্ডা দিচ্ছি । শিশুর মতো সরল ও আবেগপ্রবণ মানুষ বলেই মনে হয়েছে তাঁকে ।
তিনি শুধু যে ফুটবল মাঠেরই একজন যোদ্ধা তা নয়, তাঁকে আটকানোর জন্য, তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্রও হয়েছে বহুবার । কিন্তু, তাঁকে আটকানো যায়নি । গোটা পৃথিবী মনে করে, উনি আসলে তৃতীয় দুনিয়ার শোষিত মানুষের প্রতিনিধি । যে কারণে দেখা যায়, মারাদোনা তাঁর মতবাদ খোলামেলা ঘোষণা করেছেন বরাবর ।
ভীষণ বর্ণময় চরিত্র । ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর জীবনের আরাধ্য ব্যক্তি, পুঁজিবাদের মুণ্ডপাত, সমাজবাদের পক্ষে খোলামেলা তাঁর ঘোষণা এবং ফুটবল মাঠে তাঁর সেই ক্যারিশ্মা । আমি জানি না, খেলার জগতে এমন বর্ণময় চরিত্র মহম্মদ আলি ছাড়া আর কেউ আছেন কি না । এই রকম একজন মানুষ আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রথমবার কলকাতায় এসেছিলেন ।
আমরা একটি কথাই বলেছিলাম, "এক মিলিয়ন মানুষকে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বাদ দিয়ে কী আন্তর্জাতিক ফুটবল এগোতে পারে ? এখানে তো ফুটবলের প্রচার দরকার !" এই কথায় উনি এসেছিলেন । সেই সময় সুভাষ চক্রবর্তী বেঁচে । উনি না থাকলে এটা সম্ভব হত না । সুভাষ চক্রবর্তী যে ব্যবস্থাপনা করেছিলেন তাঁর অভ্যর্থনার - এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাসে করে তিনি যখন যাচ্ছেন, কলকাতার মানুষের উন্মাদনা দেখে তিনি বারবার বলছিলেন, "এ আমার নাপোলির রাত মনে পড়ে যাচ্ছে, যেবার প্রথম আমি নাপোলি-কে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিলাম ।" বলতে বলতে দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে আসে মারাদোনার । আমি আজও সেই দৃশ্য ভুলতে পারি না । মহেশতলায় যে বক্তব্য রেখেছিলেন সেখানেও তিনি বলেন, ভারতে যে এত মানুষ ফুটবল নিয়ে মেতে ওঠে সেটা তাঁর ধারণাতেই ছিল না । সেখানে কিছু ছোটো ছোটো প্লেয়ারকে আমরা বল জাগলিং করার জন্য বলেছিলাম । সেই দেখে তিনি বলেন, "যারা এত চমৎকার বল জাগলিং করে তারা কেন ফুটবল খেলছে না ?" তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন, "কাম, প্লে ফুটবল । দিস ইজ় দ্য মোস্ট বিউটিফুল থিং অন দা আর্থ ।" এই স্লোগান তিনি দিয়েছিলেন । তখন ধীরে ধীরে ফুটবল জনপ্রিয় হচ্ছে । আজ ওঁর চলে যাওয়াটা এতটাই অকস্মাৎ, খুবই দুঃসহ এই রাত আমার কাছে এবং গোটা পৃথিবীর সমস্ত ফুটবলপ্রেমী ও মানবদরদী মানুষের কাছে ।