পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / sports

মোহনবাগানের জন্য ইউরোপে খেলার প্রস্তাব ফিরিয়েছিলেন চুনী

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পারের হয়ে চুনীকে খেলার আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন ইংরেজ ফুটবলার বিল নিকোলাস । কিন্তু সেই প্রস্তাব "মোহনবাগানের জন্যে সবকিছু ছাড়া যায়, কোনও কিছুর জন্য মোহনবাগানকে ছাড়া যায় না," এই মানসিকতায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি ।

চুনী গোস্বামী
চুনী গোস্বামী

By

Published : Apr 30, 2020, 11:21 PM IST

কলকাতা, 30 এপ্রিল: চুনী গোস্বামী মানেই ফুটবল, তাঁর ক্যারিশমা এবং মাঠ ও মাঠের বাইরের ঘটনার কোলাজ ।

সাইরেনের শব্দে তখন ঘুম ভাঙত কলকাতার । ভারত-চিন সীমান্তে যুদ্ধের দামামা । এই সময় বিরাট অঙ্কের আর্থিক প্রস্তাব এবং উপহার হিসেবে ফিয়াট গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলের প্রবাদপ্রতিম কর্তা জ্যোতিষচন্দ্র গুহ । একসময় বাংলাদেশের ময়মনসিংহের বাসিন্দা ছিলেন চুনী গোস্বামীরা । ফলে লাল-হলুদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কর্তাকে আপ্যায়ন করে বসিয়েছিলেন চুনী গোস্বামীর বাবা । দলবদলের মরশুম তখন । প্রথমেই ছেলেকে লাল-হলুদ জার্সি পরার প্রস্তাব দিলেন জ্যোতিষবাবু । সেই সময় ফুটবলারদের ক্লাবে খেলার ব্যাপারে অভিভাবকদের মত গুরুত্ব পেত । কিন্তু সিনিয়র গোস্বামী বললেন, এই বিষয়ে বলাই দাস চট্টোপাধ্যায়ের কথাই তাঁর ছেলে মেনে চলে । বলাই চট্টোপাধ্যায় ছিলেন চুনী গোস্বামীর গুরু ।

আঠারো বছরের যুবকের সঙ্গে তখন সরাসরি কথা বললেন জ্যোতিষ গুহ । তাঁর দীর্ঘদেহী, পেশিবহুল চেহারা প্রমাণ করে ফুটবল খেলার জন্য এই চেহারাই আদর্শ । ক্লাব এবং রাজ্যের হয়ে দাপিয়ে খেললেও চুনী গোস্বামীর নাম তখনও মেলবোর্নে অলিম্পিকগামী ভারতীয় দলের জন্য বিবেচিত হয়নি । মোহনবাগান ক্লাব তার জন্য কোনও উদ্যোগ নেয়নি । স্বাভাবিকভাবেই জ্যোতিষ গুহ চুনী গোস্বামীর আবেগের জায়গায় আঘাত করে কাজ হাসিল করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু আঠারোর যুবক আবেগে ভেসে না গিয়ে পরিশ্রম করে ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়াতে চেয়েছিলেন । আর তার মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মোহনবাগান ক্লাবকে । বলেছিলেন, "আমি হয়তো যোগ্য নই । তাই ভারতের হয়ে খেলার জন্য বিবেচিত হইনি । তবে মোহনবাগান আমি ছাড়ব না ।" সেই দৃঢ়তার সামনে দাঁড়াতে পারেননি জ্যোতিষ গুহ ।

তখনকার চুনী গোস্বামী
সতেরো বছর বয়সে প্রথম সিনিয়র দলে সুযোগ পেয়েছিলেন চুনী গোস্বামী । সিনিয়র- জুনিয়র মিলিয়ে মোট বাইশ বছর সবুজ-মেরুন জার্সির জন্যে ঘাম রক্ত ঝরিয়েছিলেন তিনি । 1960 সাল থেকে অবসর নেওয়া পর্যন্ত ছিলেন মোহনবাগানের অধিনায়ক । ভারতীয় দলের হয়ে 1956 সালে চিনের অলিম্পিক দলের বিরুদ্ধে প্রথম গোল করেন । দেশের জার্সিতে 50টি ম্যাচে এগারোটি গোল রয়েছে তাঁর । যদিও FIFA-র রেকর্ড বলছে, দেশের জার্সিতে 32ম্যাচে চুনী গোস্বামীর গোল সংখ্যা 9 । 1962 সালে এশিয়ান গেমসে ভারতীয় দলের হয়ে ফুটবলে সোনা জয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি । সেবারই এশিয়ার সেরা স্ট্রাইকার নির্বাচিত হন এই বাংলার ফুটবলার । 1963 সালে চুনী গোস্বামী পান অর্জুন পুরস্কার । মাত্র 27 বছর বয়সে আর্ন্তজাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন চুনী গোস্বামী । 1964 সালে তাঁর নেতৃত্বে ভারত ফের এশিয়ার সেরা হওয়ার দৌড়ে শেষ ল্যাপে পৌঁছায় । কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি ।আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয় সেটা হল, 1960-61সালে চুনী গোস্বামীর কেরিয়ার তখন মধ্য গগনে । ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পারের হয়ে চুনীকে খেলার আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন ইংরেজ ফুটবলার বিল নিকোলাস । কিন্তু সেই প্রস্তাব "মোহনবাগানের জন্যে সবকিছু ছাড়া যায়, কোনও কিছুর জন্য মোহনবাগানকে ছাড়া যায় না," এই মানসিকতায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি । ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর চুনী গোস্বামী ক্রিকেটে মনোনিবেশ করেন । সেখানেও তাঁর সাফল্য নজরকাড়া । বাংলার নেতৃত্বের ব্যাটন সামলেছেন । 46ম্যাচে 1592 রান করা মানুষটির অধীনে বাংলা দুবার রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল খেলেছে । একটি শতরান এবং সাতটি অর্ধশতরানের মালিক চুনী গোস্বামী বল হাতেও 47টি উইকেট শিকার করেছেন । তাঁর অলরাউন্ড ক্ষমতার সামনে 1966 সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় দল নাস্তানাবুদ হয়েছিল । 1983 সালে পদ্ম সম্মান পাওয়া মানুষটি মোহনবাগানের সচিবের দায়িত্ব সামলেছেন । 2005 সালে মোহনবাগান রত্ন সম্মান পাওয়া এই কিংবদন্তি ফুটবলারের সঙ্গে মোহনবাগানের সম্পর্ক ছিন্ন হল মৃত্যুতে ।সাইরেনের শব্দে ঘুম ভাঙা কলকাতা, উত্তম সুচিত্রার সেলুলয়েডের রোমান্টিকতায় মাখা বাঙালি, জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তিদের লেখনীতে স্বপ্ন দেখা বাঙালি, সত্যজিৎ-ঋত্বিকের সিনেমায় বুঁদ বাঙালির কাছে ক্রীড়াজগতের প্রকৃত আইকন ছিলেন চুনী গোস্বামী । যার প্রয়াণে শেষ হল একটি মহাকাব্যিক যাত্রা ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details