কলকাতা, 25 জুন : একটা স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল 1983 সালের 25 জুন । লর্ডসের ব্যালকনিতে প্রথমবার বিশ্বকাপ হাতে দাঁড়িয়েছিলেন কোনও ভারত অধিনায়ক । 36 বছর আগের ঘটনা । তারপর 2 এপ্রিল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মহেন্দ্র সিং ধোনিকে বিশ্বকাপ তুলতে দেখেছে দেশ । কিন্তু প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ ও স্মৃতি সবকিছুর থেকে আলাদা । তাই ক্রিকেট বিশ্বকাপের বল গড়ালেই ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীর চোখে ভাসে কপিল দেবের কাপ হাতে হাসিমুখ ।
লর্ডসের ব্যালকনিতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের সগর্ব হাত নাড়ানোর ছবি কখনও পুরোনো হয় না । IPL অধ্যুষিত পৃথিবীতে 183 রানের পুঁজি নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা গল্প বলেই মনে হয় । আজ যা গল্প তা সেদিন ছিল বাস্তব । ফাইনালে প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ় । যাদের নামে ক্রিকেট দুনিয়া কাঁপে ।
ব্যাট হাতে গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেনস, ভিভিয়ান রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েডদের ঝলকানিতে 183 রানের গন্ডি পেরনো ছিল সময়ের অপেক্ষা । কারণ, 1975 ও 1979 সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় প্রতিপক্ষকে দুমড়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল । 83-তে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার হ্যাটট্রিকে তাই ভারতীয় দলের সামান্য বাধা ফুঁৎকারে উড়ে যাবে তা সবাই ভেবেছিল । ফেভারিট হিসেবে ধরা হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে ।
কিন্তু ভাবনা ও বাস্তবের ফাঁকটা যে বিরাট তা বোধ হয় জানা ছিল না । প্রথমে ব্যাট করতে নেমে 183 রান স্কোরবোর্ডে ওঠার পরে ভারতীয় সাজঘরে সেভাবে উচ্ছ্বাস ছিল না । মাঠে নামার আগে অধিনায়ক কপিল দেব টিম মিটিংয়ে সুনীল গাভাসকারকে বলেছিলেন, "ব্যাটে সেভাবে রান না পেলেও সানি ভেঙে পড়ো না । 183 রান না করলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় কাপ পাবে না । তাই ওদের করতে না দেওয়াই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ।"
সেই পেপ টকে এক লহমায় পুরো দলের ছবিটা বদলে গিয়েছিল । চোয়াল শক্ত করে লড়াই ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সবাই । ইংলিশ কন্ডিশন কাজে লাগিয়ে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছিলেন মদনলাল । যোগ্য সঙ্গত বলবিন্দর সিং সান্ধুর । তাঁর লেট ইনসুইংয়ে ক্যারিবিয়ান প্রথম উইকেটের পতনের ছবিটা আজও ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সোনার ছবি । মদনলাল, সান্ধুর দুরন্ত পারফরম্যান্সের পাশে কপিল দেবের বিষাক্ত সুইং দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল । মদনলালের বলে ৩৩ রানে ভিভিয়ান রিচার্ডসের আউট করতে কপিল দেবের অবিশ্বাস্য ক্যাচ বা ক্লাইভ লয়েডের পতনে ছিল শৃঙ্গ ছোঁয়ার হাতছানি ।
তারপরেই শুরু ম্যান উইথ গোল্ডেন আর্ম মহিন্দর অমরনাথের বিক্রম । ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পরে বল হাতে বিধ্বংসী হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর সুইংয়ের দিশা পাচ্ছিলেন না সেদিন ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানরা । ডট বলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল চাপ ও মুকুট হারানোর শঙ্কা । আর কপিল ডেভিলসরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন চ্যাম্পিয়ন হওয়া সম্ভব । মাঝে শেষ প্রতিরোধ দুঁজো ও ম্যালকম মার্শালের ব্যাটে গড়ে উঠলেও তা অমরনাথের সুইংয়ে শেষ হয়েছিল । অ্যান্ডি রবার্টসকে আউট করে দলকে জয়ের খুব কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন অধিনায়ক কপিল দেব । হোল্ডিংকে লেগ বিফোর করতেই পিলপিল করে ভারতীয় সমর্থকরা লর্ডস মাঠের দখল নিয়েছিলেন । ব্যাট হাতে 26 করার পরে বল হাতে 12 রানে তিনটে শিকার মহিন্দর অমরনাথকে ম্যাচের সেরার পুরস্কার এনে দিয়েছিল । সেমিফাইনালের পরে ফাইনালেও সেরা মহিন্দর । বিশ্বকাপের সেরার তকমা পেয়েছিলেন তিনি । ফাইনালে মদনলালের তিন উইকেট, সান্ধুর দুই ও কপিলের একটি শিকার আদতে অমরনাথকে যোগ্য সঙ্গত ।
শ্রীকান্তের 38, সন্দীপ পাতিলের 27, কপিলের 15 বা মদনলালের ব্যাট হাতে 17 রানের ইনিংস সংখ্যায় বড় নয় । কিন্তু তাদের সম্মেলিত প্রভাব ছিল বিরাট । 140 রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে থামিয়ে 43 রানে জয় তুলে নিয়েছিল ভারত । বিশ্বসেরার মুকুট উঠেছিল মাথায় । যা ভারতীয় ক্রিকেটের নবজাগরণের সূচনাও বটে ।
'83-র অমর কীর্তির আগে কপিলদেবের ব্যাটে ইতিহাস গড়ার হাতছানি ছিল । জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে অধিনায়ক কপিলদেবের অপরাজিত 175 রানের ইনিংস ভারতীয় ক্রিকেটের ট্রেজ়ারিতে অন্যতম কোহিনূর । কপিলের ইনিংস, মহিন্দর অমরনাথের ব্যাটে বলে দূর্লঙ্ঘ হয়ে ওঠা, মদনলাল, সন্দীপ পাতিল, শ্রীকান্ত, সান্ধু, সানিদের পারফরম্যান্স যেন বাবুইয়ের কুটির বাধার স্বপ্ন ।
ইংল্যান্ডে ফের বিশ্বকাপ । দাপট দেখাচ্ছে ভারত । তিন নম্বর বিশ্বকাপের আশায় বুক বাঁধছে দেশবাসী । যার স্বপ্নের শুরুটা 36 বছর আগে শুরু হয়েছিল আজকের দিনেই । একটা স্বপ্ন ও পথচলা ।