সবথেকে কঠিন বোধহয় এই ছবির সমালোচনা করা। কোথা থেকে শুরু করব, ঠিক কোথা থেকে শুরু করা উচিত, সেটাই ভাবা মুশকিল। কাকে আগে বাহবা দেওয়া উচিত, পরিচালককে নাকি অভিনেতাকে। যাইহোক এটুকুই বলতে পারি, নগরকীর্তন দেখার পর, নিজের মধ্যে একটা নীরবতা নিয়ে হল থেকে বেরোবেন। অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। মনে হবে ,এতদিন ধরে যাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, যাঁদের হাততালির গুঞ্জনে তামাশা করেছি, পাশ কাটিয়ে চলেছি, তাঁরাও আসলে রক্তমাংসের মানুষ। অন্য গ্রহ থেকে আসা অদ্ভুত জীব জন্তু নয়।। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল, অনেক বেশি সৎ, অনেক বেশি আপন।
এই ছবি দেখার পর হয়তো সমাজে অবাঞ্ছিত ভেবে দূরে সরিয়ে রাখা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি কিছুটা হলেও আমাদের ভাবমূর্তি পাল্টাবে। রাস্তার মোড়ে, ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় যেসব মানুষ এসে আমাদের গাড়ির কাছে টোকা দেয়, তাঁদের দিকে তাকিয়ে হয়তো না তাকানোর ভান করা হয়তো এবার ছাড়ব আমরা। হয়তো আমাদের মতোই স্বচ্ছ এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন সমাজের সেইসব বঞ্চিত মানুষরা। হয়তো কৃষ্ণনগরের কলেজের প্রিন্সিপাল মানবীর মতো মূল স্রোতে ফিরে আসবেন পুঁটি, শঙ্করী, পরীরা। আমাদের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও যে দেশের সব রকম সুযোগ-সুবিধা, একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার ভোগ করতে পারেন, তা হয়তো আরও বেশি প্রস্ফুটিত হবে সমাজের চোখে। হয়তো আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের তালিকায় তাঁরাও যুক্ত হবেন। হয়তো ধীরে ধীরে কমবে জনসমক্ষে 'ছক্কা' 'হিজরে' 'মেয়েলি' আখ্যা দেওয়াগুলো।
এবার আসা যাক ঋদ্ধির প্রসঙ্গে। এই ছবিতে অভিনয় করে আগেই জাতীয় পুরস্কার পেয়ে গেছেন তিনি। উত্তমকুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ বিরতির পর, বাঙালি অভিনেতা হিসেবে ঋদ্ধিই এই পুরস্কার পেয়েছেন। এবং যথার্থই সেই সিদ্ধান্ত। একজন বৃহন্নলার হাবভাব, কথা বলা, চলাফেরা, তাকানো হাসা, সবকিছুকে আয়ত্তে আনা নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের স্বীকৃতি দাবি করে। ঋদ্ধি ঠিক কতটা ভালো অভিনয় করেছে, সেটা যদি ২২ তারিখ ছবি মুক্তির পর হলে গিয়ে আপনি না দেখেন, অসংখ্য রিভিউ পড়ে তা ঠাহর করতে পারবেন না। আপনি যদি বাংলা ছবির দর্শক না হন, এই ছবি না দেখে কোনওমতেই আপনার বলা উচিত না বাংলা ছবি দুর্বল।
গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে যে কনটেন্টই রাজা। কনটেন্ট যদি জোরালো হয়, সংলাপ যদি মানুষের মন ছুঁতে পারে তাহলে ছবি হিট। নগরকীর্তন দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল বারবার। দর্শকাসনে বসে পপকর্নের দিকে মন যায়নি। খিদে পায়নি, পিপাসা পায়নি। এমনকী ইন্টারভালেও এক চক্কর কেটে আসতে ইচ্ছে করেনি। পরের অংশ দেখার জন্য মন ছটফট করেছে।