পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / sitara

মান ও হুঁশ-র মানে বোঝাবে 'নগরকীর্তন'.. - Nagarkirtan

নগরকীর্তন

By

Published : Feb 19, 2019, 11:55 AM IST

সবথেকে কঠিন বোধহয় এই ছবির সমালোচনা করা। কোথা থেকে শুরু করব, ঠিক কোথা থেকে শুরু করা উচিত, সেটাই ভাবা মুশকিল। কাকে আগে বাহবা দেওয়া উচিত, পরিচালককে নাকি অভিনেতাকে। যাইহোক এটুকুই বলতে পারি, নগরকীর্তন দেখার পর, নিজের মধ্যে একটা নীরবতা নিয়ে হল থেকে বেরোবেন। অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। মনে হবে ,এতদিন ধরে যাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, যাঁদের হাততালির গুঞ্জনে তামাশা করেছি, পাশ কাটিয়ে চলেছি, তাঁরাও আসলে রক্তমাংসের মানুষ। অন্য গ্রহ থেকে আসা অদ্ভুত জীব জন্তু নয়।। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল, অনেক বেশি সৎ, অনেক বেশি আপন।

এই ছবি দেখার পর হয়তো সমাজে অবাঞ্ছিত ভেবে দূরে সরিয়ে রাখা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি কিছুটা হলেও আমাদের ভাবমূর্তি পাল্টাবে। রাস্তার মোড়ে, ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় যেসব মানুষ এসে আমাদের গাড়ির কাছে টোকা দেয়, তাঁদের দিকে তাকিয়ে হয়তো না তাকানোর ভান করা হয়তো এবার ছাড়ব আমরা। হয়তো আমাদের মতোই স্বচ্ছ এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন সমাজের সেইসব বঞ্চিত মানুষরা। হয়তো কৃষ্ণনগরের কলেজের প্রিন্সিপাল মানবীর মতো মূল স্রোতে ফিরে আসবেন পুঁটি, শঙ্করী, পরীরা। আমাদের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও যে দেশের সব রকম সুযোগ-সুবিধা, একজন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার ভোগ করতে পারেন, তা হয়তো আরও বেশি প্রস্ফুটিত হবে সমাজের চোখে। হয়তো আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের তালিকায় তাঁরাও যুক্ত হবেন। হয়তো ধীরে ধীরে কমবে জনসমক্ষে 'ছক্কা' 'হিজরে' 'মেয়েলি' আখ্যা দেওয়াগুলো।

এবার আসা যাক ঋদ্ধির প্রসঙ্গে। এই ছবিতে অভিনয় করে আগেই জাতীয় পুরস্কার পেয়ে গেছেন তিনি। উত্তমকুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ বিরতির পর, বাঙালি অভিনেতা হিসেবে ঋদ্ধিই এই পুরস্কার পেয়েছেন। এবং যথার্থই সেই সিদ্ধান্ত। একজন বৃহন্নলার হাবভাব, কথা বলা, চলাফেরা, তাকানো হাসা, সবকিছুকে আয়ত্তে আনা নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের স্বীকৃতি দাবি করে। ঋদ্ধি ঠিক কতটা ভালো অভিনয় করেছে, সেটা যদি ২২ তারিখ ছবি মুক্তির পর হলে গিয়ে আপনি না দেখেন, অসংখ্য রিভিউ পড়ে তা ঠাহর করতে পারবেন না। আপনি যদি বাংলা ছবির দর্শক না হন, এই ছবি না দেখে কোনওমতেই আপনার বলা উচিত না বাংলা ছবি দুর্বল।

গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে যে কনটেন্টই রাজা। কনটেন্ট যদি জোরালো হয়, সংলাপ যদি মানুষের মন ছুঁতে পারে তাহলে ছবি হিট। নগরকীর্তন দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল বারবার। দর্শকাসনে বসে পপকর্নের দিকে মন যায়নি। খিদে পায়নি, পিপাসা পায়নি। এমনকী ইন্টারভালেও এক চক্কর কেটে আসতে ইচ্ছে করেনি। পরের অংশ দেখার জন্য মন ছটফট করেছে।

তবে একটা কথা বলে রাখা ভালো, ট্রেলারে যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, ছবি কিন্তু তাঁর থেকে অনেক আলাদা। সমালোচক হিসেবে অবশ্য ক্লাইমেক্স বলে দেওয়া বারণ। সিনেমার মাঝখানে এসে অভিনেতা ঋদ্ধি নিজেই বলে গেলেন, "আপনারা যারা সমালোচনা করতে এসেছেন, দয়া করে ছবির ক্লাইম্যাক্সটা বলবেন না।" এত ভালো অভিনয় করেছেন যিনি, তাঁর এইটুকু অনুরোধ রাখা যেতেই পারে। যাঁরা মনে করেন বাংলা ছবি দেখার যোগ্য নয়, বাংলা ছবি বাহুবলী নয়, তাঁদের বলে রাখি, 'নগরকীর্তন', 'ভবিষ্যতের ভূত'-র মতো ছবির কারণে বাংলা ছবির বাহুতে বল আসছে। হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণালী যুগ হয়তো ফিরে আসছে আবার নতুনভাবে। নতুন মোড়কে, নতুন নতুন দর্শকের জন্য। যাঁরা হিরো হিরোইনের নাচ দেখতে ভালোবাসে না, ভালোবাসেন বিষয়বস্তু, এই ছবি তাঁদের জন্য।

এখানে আরও কিছু জিনিস বলা বাঞ্ছনীয়। ছবিতে অভিনয় করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই। হল থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁদেরই একজনকে অভিনন্দন জানাতে গেলে, সুমিষ্ট ব্যবহারের সঙ্গে তিনি বললেন, আমাদের স্যারের (পড়ুন কৌশিক গাঙ্গুলী) এই ছবিকে আপনারা এগিয়ে দিন। আমাদের নিয়ে তো সেরকমভাবে কেউ কথা বলে না। হয়তো মানুষগুলো বল ফিরে পেয়েছে। তাঁদের কথাও যে কেউ বলবে, তেমন একজন মানুষ যে এসেছে তাতেই তাঁরা খুশি।

নগরকীর্তন ছবির নাম যখন, সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে কীর্তন এবং সেই সমাজের কিছু চিত্র। অসামান্য কিছু কীর্তন সংগীত রয়েছে ছবিতে। রয়েছে কৃষ্ণ রাধার প্রেম বর্ণনা। এক পুরুষের শরীরে আটকে থাকা নারীর তীব্র যন্ত্রণা। মধুর চরিত্রে ঋত্বিক অনবদ্য, পুঁটির চরিত্রে ঋদ্ধি, এবং আরতির চরিত্রে শংকরী।

ছবিতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবনকে খুব কাছ থেকে পরীক্ষা করেছেন পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলী। আমাদের অজানা অনেক কিছুই আছে সেখানে। এমনকী রয়েছে সেই সমাজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিশ্লেষণ। ভারী গলার কণ্ঠস্বরের তলে লুকিয়ে থাকা নরম তুলতুলে একটা মনকে আবিষ্কার করেছেন পরিচালক। তাঁর এই প্রয়াসকে সাধুবাদ তো দিতেই হয়। আপন করে নিতে হয় সেই মানুষগুলোকে, যাঁদের সমাজ বিতাড়িত করেছে অন্ধগলিতে। যারা পাঁচ দশ টাকার বিনিময়ে আমাদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন ভগবানের কাছে। এবং আমরা অনেকেই একটু বিশ্বাস করি তাঁদের আশীর্বাদের জোর কতখানি। তাই যে মানুষগুলোর থেকে প্রতিনিয়ত আশীর্বাদ পেয়ে চলেছি, তাঁদের আপন করতে সাহায্য করবে। ভয় পেতে নয়। দূরে সরাতে নয়। ছবি দেখে আসুন। নিজেকে পাল্টাতে সুবিধে করবে।

For All Latest Updates

ABOUT THE AUTHOR

...view details