৬৫ বছর বয়সে এসে জীবনের উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে শেষমেশ একটি সাহসী ভালোবাসার কথা বলে গেল গেলেন অঞ্জন দত্ত। সত্যিই! 'ফাইনালি ভালোবাসা'-র যথার্থ নাম। যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল রাগ, দুঃখ অভিমান। মনের ব্যাপ্তির অনেকটা দেখা গেল পরিচালকের লেন্সে। নিজেকে দর্শক আসনে বসিয়ে সমাজের বিচ্ছিন্ন প্রেমের গল্প বলে গেলেন বেলা বোসের প্রেমিক। ফাইনালি, চোখ থেকে জল পড়ল। থমকে গেল জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব-নিকেশ। সবকিছুর ঊর্ধ্বে জয় হল সেসব অনুভূতির যা চিরকালই পাশ কাটিয়ে চলেছি আমরা। সেই আমাদের প্রেম। সেই আমাদের গোপনে থাকা আদর। লুকিয়ে থাকা কান্না। বা না বলা কোনও কথা।
জীবনের সবচেয়ে শেষে আসে ভালোবাসা, যা আমাদের সঙ্গে চিরস্থায়ী। যাকে আমরা দেখতে পাই হয়তো কখনও -সখনও। সেরকমই তিনটি গল্পের বুনোটে তৈরি 'ফাইনালি ভালোবাসা' ছবিটি। তিনটে গল্পকে তিনটে অসুখের নাম দিয়েছেন পরিচালক। ইনসমনিয়া (ঘুম না আসার অসুখ), আর্থ্রাইটিস (জয়েন্ট ফুলে যাওয়া) এবং এইচআইভি (কোনও দিন ছাড়ে না এমন অসুখ, ছোঁয়াচেও)।
ইনসমনিয়া গল্পে দেখা গেল ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। একজন ধনী স্বামী তার সুন্দরী স্ত্রীকে দিনের পর দিন নির্যাতন করে চলেছেন শারীরিক এবং মানসিকভাবে। এবং তার প্রতি দরদি, স্বামীর তত্ত্বাবধানে থাকা এক যুবক। এই তিনটি চরিত্র করেছেন অর্জুন চক্রবর্তী, রাইমা সেন এবং অরিন্দম শীল। একটি পরকীয়া প্রেমের গল্প এবং অবশেষে ঘুমের দেশে চলে যাওয়া সেই স্ত্রীর মর্মান্তিক পরিণতি। পরকীয়া প্রেমকে সমাজে এখনও সাদরে গ্রহণ করা হয় না। যদিও সুপ্রিম কোর্টের রায় অন্য কথা বলে। প্রশ্ন ওঠে, বিবাহিত হয় কেন সে অন্য প্রেম করবে। কিন্তু অন্য প্রেম করার নেপথ্যে কারণ কী, তা কখনও তলিয়ে দেখে না কেউ। সেই প্রশ্নই অঞ্জন দত্ত ছুড়ে দিয়েছেন দর্শকদের সামনে।
আর্থ্রাইটিস গল্পের নেপথ্যে রয়েছেন পরিচালক নিজেই। এবং তাঁর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন শৌরসেনী মৈত্র। অসম বয়সী প্রেমের গল্প বলে এটি। যেহেতু অসম বয়সী প্রেম, তাই পরিচালক অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে গল্পের নাম দিয়েছেন আর্থ্রাইটিস। বার্ধক্যে এসে কোনও এক সুন্দরীর প্রবেশ জীবনে কীভাবে তার প্রভাব বিস্তার করল, তা জানতে আপনাকে হলে আসতেই হবে।
অন্য গল্পটির নাম এইচআইভি। মানে কোনও এক মারণব্যাধি। এখানে সমকামী প্রেম দেখানও হয়েছে। দুই পুরুষের মধ্যে একটি চরিত্র করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ধনঞ্জয়ের পর বড় পর্দায় অনির্বাণের অন্যতম সেরা অভিনয়। যেখানে তাঁকে অসংখ্য সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আর অভিনয় প্রতিভা দেখানোর জন্য প্রত্যেকটিতেই ছক্কা মেরেছেন অনির্বাণ। আজ পর্যন্ত বেশিরভাগ সমকামি গল্পেই দু'জন মানুষের মধ্যে একজনকে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে দেখে এসেছে দর্শক। দর্শক কোনওভাবে সেই ট্রান্সজেন্ডার মানুষটির মধ্যে একটি নারীকে খুঁজে পায়। তাই দর্শকের কাছে হয়তো তা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু পুরুষে পুরুষে প্রেম কিন্তু সচরাচর দেখাতে পারেন না পরিচালকরা, যা দেখিয়েছেন অঞ্জন দত্ত। এখানে দু'জন পুরুষের মধ্যে একজন হোমোফোবিক, অধিকাংশ দর্শকই তাই। হোমোফোবিয়ার দিক থেকে এই গল্প যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
গল্পে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দার্জিলিং। অনেকদিন পর অঞ্জন দত্তের ছবিতে দার্জিলিং ঘুরে ফিরে এল। হয়তো ৬৫ বছর বয়সে ফাইনালি ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে তার বেড়ে ওঠার জায়গা দার্জিলিংকে বাদ দিতে পারেননি পরিচালক। আর রয়েছে তাঁর পুরোদস্তুর অভিনেতা না হতে পারার দুঃখের সংলাপও। অনির্বাণের মুখের সংলাপ, আই ওয়ান্ট টু বিকাম অ্যান অ্যাক্টর কথাটা শুনে যেন মনে হবে, সেটি অঞ্জন দত্ত নিজেই বলছেন নিজের ব্যাপারে।
গল্পের শেষটা এখানেই যদি বলেদি, তাহলে ছবিটি হলে দেখার আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে। তাই ফাইনালি ভালোবাসা দেখতে গেলে আপনাকে ফাইনালি হলে যেতেই হবে।