পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / sitara

শঙ্কর মুদির চোখ আড়ালে হাজারো শঙ্করের গল্প বলল অনিকেতের ছবি - koushik ganguly

শঙ্কর মুদি

By

Published : Mar 16, 2019, 7:23 PM IST

একটা নামজাদা শপিংমল রাতারাতি পালটে ফেলে একটি পাড়াকে। বিশেষ করে বদল আসে এক মুদি দোকানীর জীবনে। এমনই একটি সূক্ষ্ম গল্প পরদায় বর্ণনা করেছেন পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর চোখে ধরা পড়েছে বছর কয়েক আগে ফেলে আসা কলকাতা শহর এবং সেই শহরের একটি পাড়া। আসলে এই পাড়াটি একটি রূপকমাত্র। আসল বিষয় হল এই পাড়াটি প্রতিনিধিত্ব করে কলকাতা শহরের মধ্যবিত্ত সমাজকে। যে সমাজে প্রতি রবিবার কিংবা ছুটির দিনে থলে হাতে বাড়ির বাবুরা বেরিয়ে পড়েন বাজার করতে। মাছ, মাংস, সবজি, ফল কেনার পর সেই থলে গিয়ে জমা পড়ে মুদির দোকানে। মুদির দোকানি থলে ভরতি করে দেয় মাস্কাবারি সামান। পাশে পড়ে থাকা খাতায় চলতে থাকে হিসেব-নিকেশ কষা। তাদের কারোর কাছে সোয়াইপ মেশিন নেই। ধার বাকিতে খাতায় কলমে চলে ডেবিট-ক্রেডিটের হিসেব। তেমনই একজন মুদি দোকানি শংকর। যে চরিত্রটিকে পরদায় অসম্ভব ভালো ফুটিয়েছেন কৌশিক গাঙ্গুলি। বরাবরের মতো এই ছবিতেও তাঁর অভিনয় বিশেষ দাগ কেটে যায়।

শুধু শঙ্কর নন, যে পাড়ায় তার দোকান (বাসস্থানও বলা যেতে পারে), সেই পাড়ার বাসিন্দারাও এই ছবিতে সমান গুরুত্বপূর্ণ। কালীর চরিত্রে শাশ্বত এক অনন্য নজির গড়েছেন এই ছবিতে। বহুরূপীর চরিত্রে রুদ্রনীল বেশ ভালো। স্কুল মাস্টারের চরিত্রে অঞ্জন দত্তকে অন্য রকম লেগেছে। বিশেষ করে অঞ্জনের কিছু সংলাপ মনে দাগ কেটে যাবে। শঙ্কর মুদির বিপর্যস্ত অবস্থার কিছু দৃশ্য দেখেও দর্শক চোখের জল ফেলবেন। এই জায়গাতেই বলে বলে ছক্কা মেরেছেন কৌশিক‌। এ এমন এক পাড়ার গল্প, যা খুব সচরাচর দেখা যায় উত্তর কলকাতায় কিংবা দক্ষিণ কলকাতার শেষ প্রান্তে। যেখানে মানুষ থাকে মানুষের পাশে। পাড়ার অমুককাকুর শরীর খারাপ হলেও তমুক দাদা রাতবিরেতে পাশে এসে দাঁড়ায়। আপদে-বিপদে তারা একে অপরের সঙ্গী।

ছবির শুরুর দিকে এমনই চিত্র ফুটে ওঠে পরদায়। মুদির দোকান অন্নপূর্ণা ভাণ্ডারের তেলচিটে দেওয়াল, খদ্দেরের নিত্য আনাগোনা ও অসম্ভব ব্যস্ততা দিয়ে শুরু হয় ছবি‌। শঙ্করের ছোটো মেয়েটিও (প্রিয়াঙ্কা) এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তার মা নমিতার (শ্রীলা মজুমদার) সাজানো রোজনামচা এক সমাজ চিত্র তুলে ধরে। সেই পাড়াতে তারও রয়েছে একটি লেডিস টেইলারিংয়ের দোকান‌। সেই পাড়াতেই রয়েছে সেলুনের দোকানও‌। নিত্য প্রয়োজনের সবকিছুই হাতের সামনে। কিন্তু এক ছাদের তলায় নয়।

তার কিছু সময় পর থেকেই আসে বদল। পাড়ায় কাছেপিঠেই একটি শপিং মল গজিয়ে ওঠে এবং তাতেই মৌমাছির ঝাঁকের মতো আনাগোনা শুরু করে সকলে। ঠান্ডা মলের হাওয়া খেতে সবাই তখন আগ্রহী। কেইবা চাইবে তেলচিটে দোকান থেকে মুদি বাজার করতে। ‌ ধীরে ধীরে পালটে যায় চিত্রটা‌। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় শঙ্কর মুদির নমিতার এবং নারান, কালীদের। গ্লোবালাইজেশন গ্রাস করতে শুরু করে সাদামাঠা জীবন যাত্রাকে। কদর হারায় শঙ্কর মুদিরা। একসময়ের শঙ্কর নিজে গিয়ে দেখে আসে সেই শপিং মল। যেসব মানুষ তাদের গ্লোবালাইজেশনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলেছিল, তাদেরই শঙ্কর দেখতে পায় শপিংমলে। সেইসব টুকরো চমকের বিস্তারিত বিবরণ দিলে হলে গিয়ে ছবি দেখার আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে। ‌

এই ছবি দেখে হল থেকে বেরিয়ে আসার পর আপনার বিবেক জাগ্রত হবেই‌। এক ফেলে আসা সময়কে বড় পরদায় তুলে ধরেছেন পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। এ ছবি শুধু বিনোদনমূলক নয়। এতে লুকিয়ে আছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের গল্প। রয়েছে সামাজিক বার্তাও‌। ছবিতে বিশেষ চরিত্র হয়ে উঠেছে প্রয়াত শিল্পী প্রতীক চৌধুরীর গান।

সবশেষে বলতে হয়, এই ছবি আপনার আমার মনকে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ করে দেবে‌। হয়তো পালটে যাবে আপনার চিন্তাভাবনা। উন্নত শপিংমলে বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে জিনিস কেনার বদলে মাঝেমধ্যে হয়তো আপনি ঢু মারবেন পাড়ার সেই মুদি দোকানগুলিতেও‌, যারা আজ প্রগতির চাপে ধুঁকছে। এই ছবি সকলকে নিয়ে এগিয়ে চলার ছবি।

ABOUT THE AUTHOR

...view details