পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / sitara

"আমাকে যে মাপের অভিনেতা বলা হয়, সেই অনুযায়ী অত কাজ করি আমি ?" - নেপোটিজ়ম নিয়ে রুদ্রনীল ঘোষ

কলকাতা : সাম্প্রতিককালের বেশকিছু ঘটনা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ । সরাসরি না হলেও, তীক্ষ্ণ অভিনয়ের মাধ্যমে সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক বিষয় নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করছেন তিনি । রুদ্রনীলের কিছু বক্তব্য রীতিমত ভাইরালও হয়েছে । সম্প্রতি সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর ইন্ডাস্ট্রিতে নেপোটিজ়ম নিয়ে চর্চা তুঙ্গে । সেই নিয়ে রুদ্রনীলও কিছু বক্তব্য রেখেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে । এইসব নিয়ে কথা বলতে ETV ভারত সিতারা যোগাযোগ করল অভিনেতার সঙ্গে ।

Rudranil Ghosh on Nepotism in tollywood
Rudranil Ghosh on Nepotism in tollywood

By

Published : Jun 24, 2020, 4:44 PM IST

ETV ভারত সিতারা : চারপাশের অবস্থা দেখে কী বলবেন ?

রুদ্রনীল ঘোষ : আমি এই জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে । টলিউড, বলিউড দুটো জায়গাতেই কাজ করেছি । সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক । তিনি প্রতিভাবান একজন মানুষ ছিলেন । তার উপর অল্প বয়স । এই লকডাউনের সময় বাকি যাঁরা চলে গিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের বাঁচার ইচ্ছে ছিল । সেই জন্যই তাঁরা হাসপাতালে ভরতি ছিলেন । ওয়াজিদ খান, ঋষি কাপুর, ইরফান - প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই বিষয়টা এক । তাঁরা প্রত্যেকেই সুশান্তের থেকে বয়সে অনেক বড় । কিন্তু সুশান্ত স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছেন এবং কারও নামে কোনও অভিযোগ করেননি । এটা হচ্ছে অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় । প্রফেশনাল কারণে কয়েকটি প্রযোজনা সংস্থা ওঁকে বাদ দিয়েছিল । তাই অধিকাংশ মানুষ মনে করে নিচ্ছেন, এই যন্ত্রণা বা ডিপ্রেশন থেকে এত ইয়ং, ফুটফুটে, প্রতিভাবান একটি ছেলে চলে গেল । রেগে গেছেন তাঁদের উপরে, যাঁরা নেপোটিজ়মকে প্রোমোট করেন । তাঁদের সমর্থন করা কোনমতেই বাঞ্ছনীয় নয় । কিন্তু মুশকিলটা হল যে, পুলিশ কিংবা আদালত সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই কয়েকজন মানুষের দিকে আঙুল তুলে দিচ্ছি আমরা । এই বিষয়টি আমার খুব গোলমাল লাগছে । সুশান্ত যেহেতু নিজে বলে যাননি, আর যেহেতু কোনও পোক্ত প্রমাণ নেই, সুশান্তের ব্যাংকে 50 কোটির উপর টাকা রয়েছে, সেটা ভারতবর্ষের মত একটি গরিব দেশে মজার বিষয় নয় । এই টাকাটা তো কাজ করেছেন বলেই সুশান্ত রোজগার করতে পেরেছেন । এই টাকা তো তাঁকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই দিয়েছে । নেপোটিজ়ম থাকুক বা না থাকুক, মুম্বইতে কোনও চরিত্র পাওয়া মানে লটারি পেয়ে যাওয়া । মান-সম্মান, অর্থ সবমিলে ন্যূনতম 5 কোটি টাকা রেট হয় । সেটার জন্য কমবেশি প্রত্যেকেই লড়াই করেন। রাজকুমার রাও, নওয়াজ়ুদ্দিন সিদ্দিকি, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, ভিকি কৌশল, রণবীর সিং, আমরা এই নামগুলোকে মুছে দেব কী করে ? এঁরা তো কেউ নেপোটিজ়মের ধ্বজা ধরে আসেননি । পরিসংখ্যান বলে, চিরকালীনভাবে সর্বভারতীয় স্তরে বিখ্যাত মানুষরা কিন্তু নেপোটিজ়মের বাইরের মানুষ । তাহলে কেবল নেপোটিজ়মই কারণ, এটা কী করে সম্ভব হয় ? কেউ একবারও বিচার করছেন না, সুশান্তের ম্যানেজার ছিলেন যিনি, সেই দিশা, সুশান্তের মৃত্যুর 6 দিন আগে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আমার খুব প্রিয়জন যদি এই অবস্থায় আত্মহত্যা করে, সেই কারণেও তো তাঁর মনকষ্ট বা ডিপ্রেশন হতে পারে । সেটা নিয়ে কি আমরা কেউ ভেবেছি ? দু'তিন মাস আগেই তাঁর বান্ধবী রিয়া সুশান্তকে ছেড়ে চলে যান । তাহলে কোনটা কারণ ? আমরা কিন্তু কেউ জানি না । সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পিছনে শুধুমাত্রই যে নেপোটিজ়ম রয়েছে, এটা আমি বিশ্বাস করি না । ছেলেটি লড়াকু ছেলে ছিল । বাকি যাঁদের নাম বললাম তাঁদের মতোই । তিনি তাঁর পড়াশোনার ক্যারিয়ার ছেড়ে ঝুঁকির জীবিকা বেছে নিয়েছিলেন । টেলিভিশনে এসে জনপ্রিয় হয়েছিলেন । সেখান থেকে বড় পরদা । মুম্বইতে টেলিভিশন থেকে বড় পরদায় এসে সফল হওয়া খুব কঠিন । সেই সবকটি বাঁধ ভেঙেছিলেন সুশান্ত । যেদিন তিনি এই বাঁধগুলো ভাঙছিলেন, সেদিনও ইন্ডাস্ট্রিতে নেপোটিজ়ম ছিল । নেপোটিজ়মে মানুষকে একটুখানি ধাক্কা মেরে এগিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু স্টার বানানো যায় না । স্টার তৈরি করেন মানুষ । এরকম অনেক মানুষের সন্তান এসেছেন এবং হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন । অমিতাভ বচ্চনের মতো মানুষও 10-15 বছর ডিপ্রেশনে ছিলেন । সেই লোকটা সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন । এই পেশায় ওঠানামা রয়েছেই । আমি নিজে এই পেশায় রয়েছি । মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলেও, একটা ভালো চরিত্র পাওয়ার জন্য আমাদের লড়াই করতে হয় । সেক্ষেত্রে কেউ জিতি, কেউ হেরে যাই । সুশান্ত সিং রাজপুত ডিপ্রেশনে পড়ে যাওয়ার মতো কেউ নন। ডিপ্রেশন কাটিয়ে কাটিয়ে লড়াই করে বড় হওয়া একজন মানুষ । নেপোটিজ়মের জন্য তিনি চলে গেলেন, তাহলে ব্যাংক একাউন্টে এতগুলো টাকা এল কী করে ? মনোজ বাজপাইয়ের কথা ভাবুন । সুশান্ত কেন, অনেকের থেকে অনেক বড় মানের অভিনেতা । সেই মানুষটার ক্যারিয়ার প্রায় প্যাকআপ হয়ে গিয়েছিল । আবার মানুষটা ফিরেছেন 'ফ্যামিলি ম্যান'-এর মত একটি ওয়েব সিরিজ় করে । আবার তাঁকে সিনেমা ডাকছে । সুতরাং, ভালো অভিনয় করা একটা জিনিস আর দর্শক টানা আর এক জিনিস ।

.

ETV : শ্রীলেখা মিত্র সম্প্রতি একটি লাইভ করেছেন । সেই কী বলবেন?

রুদ্রনীল : শ্রীলেখার সঙ্গে আমার প্রফেশনাল বিষয়ে কোনও কথা হত না । ও আমার থেকে সিনিয়ার । আমার বয়সী মানুষ হলেও, আমার অনেক আগে জনপ্রিয় হয়েছেন শ্রীলেখা । অত্যন্ত সুঅভিনেত্রী । শ্রীলেখার ব্যাপারে আলোচনা করতে গেলে সুদীপ্তা চক্রবর্তীর ব্যাপারেও আলোচনা করব । সুদীপ্তা জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরেও বছর দু'য়েক কোনও কাজ পায়নি । শ্রীলেখা প্রচুর বিজ্ঞাপন করেন । এখনও তাঁকে বিজ্ঞাপনে দেখা যায় । সেই বিজ্ঞাপন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে দেওয়া হয় না । তাহলে শ্রীলেখা মিত্রকে দেওয়া হয় কেন ? প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত প্রায় 12 বছর কাজ করেননি । তাহলে সেই সময় কী ঘটনা ঘটেছিল ? উনি বুম্বাদা সম্পর্কে অভিযোগ তুলেছেন । এই অভিযোগ সত্যি না মিথ্যে আমি জানি না । ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে তো আমি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে 12 বছর কাজ করতে দেখিনি । শ্রীলেখার জন্য দুঃখ পেতে গিয়ে আমি সুদীপ্তার জন্য দুঃখ পাব, আমার নিজের জন্য দুঃখ পাব । আমাকে যে মানের অভিনেতা বলা হয়, সেই অনুযায়ী কি আমি অত কাজ করি ?

ETV : এক জায়গায় চিরঞ্জিত চক্রবর্তী বলেছেন, বলিউডে নেপোটিজ়ম রয়েছে, টলিউডে রয়েছে ফেভারিটিজ়ম । আপনি কি একমত ?

রুদ্রনীল : ফেভারিটিজ়ম তো থাকবেই । পরিচালক যাঁকে পছন্দ করছেন, তিনি তো তাঁকে নেবেনই । সত্যজিৎ রায় কেন বারবারই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কাজ করেছেন ? সেই সময় কি আর কোনও দুর্দান্ত অভিনেতা ছিলেন না ? আজকে যদি টলিউডের ফেভারিটিজ়মকে দোষ দিতে হয়, তাহলে তো আমি শুরু করব সম্মানীয় সত্যজিৎ রায়কে দিয়েই । প্রত্যেক পরিচালকের বিশেষ কিছু অভিনেতা বা অভিনেত্রী সম্পর্কে দুর্বলতা থাকে, তার মানে এটা নয় কেউ খারাপ কেউ ভালো । এটা কি আপনি অস্বীকার করতে পারেন ? ফেভারিটিজ়ম নিঃসন্দেহে রয়েছে । এখানে একজন পরিচালক তাঁর পছন্দের মত কাস্ট করে ।

.

ETV : তাহলে আপনি বিষয়গুলোকে মেনে নিয়েছেন ?

রুদ্রনীল : ১০০% । তার কারণ হচ্ছে, একটা সময় হয়তো আসতে পারে, যখন আমাকে ছাড়া কিছু ভাবা হবে না, তখন অন্য কেউ সেটাকে মেনে নেবে । তার জন্য যেসব পরিচালক আমার বন্ধু, তাঁদের আমি গালাগালি দেব । কে কার প্রেমে পড়বে, সেটার কোনও সিলেবাস হয় ? এটা তো একধরনের প্রেমই । প্রেমের সময় সমস্ত লজিক কি মেলে ? মেলে না । কিন্তু তাতে আমি আমার মনোবল হারাবো কেন ? দর্শক তো আমাকে মেনে নিয়েছেন । যাঁদের জন্য বাংলা সিনেমা দেখা যায় বলে মিম বের হয়, সেখানে দর্শক তো রুদ্রনীল ঘোষের ছবিটা লাগাতেও ভোলেন না । তাই কিছু খারাপ লাগা, কিছু ভালো লাগার জায়গা থাকবেই । ফেভারিটিজ়ম আমার পছন্দ না হলেও, আমি সেটা অস্বীকার করতে পারব না । আমি অ্যাপিল করতে পারি তাঁর কাছে । কিন্তু দিনের শেষে সিনেমা হল ডিরেক্টর্স মিডিয়াম, তাঁরাই ঠিক করেন তাঁদের কার সঙ্গে কাজ করতে কম্ফোর্টেবল লাগছে ।

ETV : সেরকম টিউনিং হয়..

রুদ্রনীল : একদম । একজন পরিচালকের যদি এক্স বলে কাউকে ভালো লাগতে শুরু করে, তার মানে এটা নয় যে, এক্সই সেরা পারফর্মার । এক্স হলেন তাঁর সেরা পারফর্মার । তার মানে এটা নয় যে বাকিরা দুর্বল । একসময় উত্তমকুমার ইন্ডাস্ট্রিকে রুল করতেন । আজ যাঁরা ভালো অভিনেতাদের জন্য কান্নাকাটি করছেন, সেই দর্শকের আমি একটা ছোট্ট প্রশ্ন করতে চাই । যেই সুশান্ত সিং রাজপুতের জন্য আপনারা কান্নাকাটি করছে, তাঁর ক'টা সিনেমা আপনারা হাউসফুল করে দেখেছিলেন ? আপনারা যদি হাউসফুল করিয়ে দিতেন, তাহলে নেপোটিজ়ম বলে যে বিষয়টি, সেটি মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারত না । দিনের শেষে প্রযোজকরা দেখেন, আমি 100 কোটি টাকা লাগাচ্ছি, কোন অভিনেতা সেটাকে 101 কোটি করতে পারেন । তখন তাঁরা সুশান্তের ছবি না দেখে সালমান খানের ছবিতে হাততালি দিতে গিয়েছিলেন ।

.

ETV : দর্শকের উপর তাহলে সবটাই নির্ভরশীল ?

রুদ্রনীল : ১০০% । সুশান্তের মত একজন গুণী ছেলে অকালে চলে গেলেন, খারাপ তো লাগবেই । এখন মানুষ অনেক বেশি আবেগ থেকে কথাগুলো বলছেন । তাঁদের আবেগকে আমি সমর্থন করি । আমি এটুকু বলব, আমার বা ঋত্বিকের মানের অভিনেতারা এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে যা পেয়েছি, সেটা তুলনায় অনেক । আমাদের ঘরানার যাঁরা আগের অভিনেতা ছিলেন, খরাজ মুখার্জি, রজতাভ দত্ত, শান্তিলাল মুখার্জি, রাজেশ শর্মা, তাঁরা তো আমাদের থেকে বেশি ফেম পাননি । নাসিরুদ্দিন শাহ কি অমিতাভ বচ্চনের মত ফেম পেয়েছেন ? তাহলে আলোচনা হচ্ছে কেন ? দর্শক অমিতাভ বচ্চনকে সেরা মনে করেছেন । তাঁরা ঠিক করেছেন, নাসিরুদ্দিন শাহকে সম্মানের ঘরে রেখে দেবেন, অমিতাভ বচ্চনকে জোরে হাততালি মারবেন । কিন্তু বিশ্বব্যাপী অভিনয়ের মানচিত্রে নাসিরুদ্দিন শাহকে অনেক উপরে রেখে দেওয়া হয় । আমার যখন 'চ্যাপলিন' বেরোলো যতটা সম্মান আমি পশ্চিমবঙ্গে পেয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেকবেশি সম্মান আমাকে গোটা পৃথিবী দিয়েছে । একজন শিল্পী চান তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী পারফরমেন্স দেখাতে । আমি সত্যি বিশ্বাস করি না সুশান্তের মতো এক লড়াকু ছেলে, তাঁর লেখাপড়ার ক্যারিয়ার ছেড়ে, ফিল্ম জগতে প্রতিস্থাপন করেছেন, তাঁর নেপোটিজ়ম নিয়ে আতঙ্ক কিংবা ভয় ছিল । যোগ্য লোকেদের খুব একটা ভয় থাকে না, যদি না তাঁরা হুড়োহুড়ি না করেন । আমার মনে হয় না সুশান্ত সেটা করেছিলেন । আমার কাছে নেপোটিজ়ম খারাপ । চলে গেলে ভালো হয় । তবে যেমন জনগণের কাছে ক্ষমতা আছে সরকার পালটে দেওয়ার, ঠিক তেমনই দর্শকের কাছে ক্ষমতা আছে এই মানসিকতা পালটে দেওয়ার । আমিতো আলিয়া ভাটকে নেপোটিজ়মের ব্যাড রেজ়াল্ট বলতে পারব না । তিনি অত্যন্ত ভালো অভিনেত্রী । নেপোটিজ়মে গাইডলাইনটা ভালো পাওয়া যায় । অনেক সময় বেঁচে যায় । তবে যোগ্য মানুষকে বাদ দিয়ে, অযোগ্য রক্তকে যোগ্য বলে যে নেপোটিজ়ম, আমি তার বিরুদ্ধে ছিলাম আছি এবং থাকব ।

.

ABOUT THE AUTHOR

...view details