কলকাতা : সন্তু মুখার্জির অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায় । ক্যারিয়ারের শুরুতে একটা-দুটো কাজের পর প্রায় সব ধারাবাহিক এবং ছবিতেই সন্তু মুখোপাধ্যায়কে কাস্ট করতেন তিনি । তাঁকে বাদ দিয়ে কিছু করার কথা ভাবতেই পারতেন না । সেই মানুষটিকে কাছ থেকে দেখেছিলেন লীনা । সন্তু মুখার্জির চলে যাওয়াকে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না তিনি । ETV ভারত সিতারার সঙ্গে সন্তু মুখার্জি সম্পর্কে একাধিক কথা শেয়ার করলেন ।
লীনা বললেন, "ধারাবাহিক ও ছবি মিলিয়ে সন্তুদার সঙ্গে একাধিক কাজ করেছি । এই জানুয়ারি মাসে ওঁর সঙ্গে আমার শেষ কাজ হয়েছে । আমার দিক থেকে বলতে গেলে, খুব লস্ট ফিল করছি । ওঁর অভিনয় আমার খুব ভালো লাগত । তাই ওঁকে বাদ দিয়ে ভাবতেই পারতাম না । শেষদিকে উনি আর কাজ করতে পারছিলেন না । বলেছিলেন, 'আমাকে ছেড়ে দাও'। 'মোহর' ধারাবাহিকের সময় ওঁর শরীর খুব খারাপ হয়ে যায় । ডাক্তারের কাছে গিয়ে একাধিক টেস্টও করান । তখনই ক্যানসার ধরা পড়ে । তারপরই ওঁর জায়গায় অন্য কাউকে নিতে বাধ্য হলাম আমরা । সেই চরিত্রটা তো এখন দুলাল লাহিরি করছেন । সন্তুবাবুর জায়গায় অন্য কাউকে মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না । সেটা তাঁকে জানাই । সুস্থ হয়ে ফের কাজে যোগ দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি । তার মাঝেও অনেক কথা হয়েছে । একবার হাসপাতালে থাকাকালীনও ফোন করেছিলাম । কিন্তু, উনি হাসপাতালে যেতে বারণ করেছিলেন । বাড়িতে যেতে বলেছিলেন । গত রবিবার আমার ওঁকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু, বীরভূমে যেতে হয়েছিল বলে আর যাওয়া হয়নি । ভেবেছিলাম পরের রবিবার যাব । সেই সুযোগটা আমি আর পেলাম না... সন্তুদা চলে গেলেন ।"
শেষমুহূর্তে পাশে থাকতে না পারার এই বিষয়টি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না লীনা । বারবার বলেন, "এটাই আমার খুব আফশোশ থেকে গেল । আমার নিজের মনে হয় এরকম একজন অভিনেতা খুব বিরল । ওঁর মতো অভিনেতার কোনও বিকল্প হয় না । উনি যে স্বাভাবিকতা রেখে অভিনয় করতেন, সেটা দেখে কখনও মনে হয়নি উনি অভিনয় করছেন ।"
লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ও শৈবাল মুখোপাধ্যায়ের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি 'সাঁঝবাতি'-তেও অভিনয় করেছিলেন সন্তু মুখার্জি । এ প্রসঙ্গে লীনা বলেন, "এমন একটা মানুষকে পরিচালনা করতে গিয়ে অধিকাংশটাই শিখেছি । 'সাঁঝবাতি'-তে একটা দৃশ্য ছিল, রাত্রিবেলায় টিউশন করে ঠান্ডায় তিনি বাড়িতে ঢুকছেন । একজন মাস্টারমশাই বাড়ি-বাড়ি ঘুরে পড়ান, সেটা তো যথাযথই । কিন্তু, সেখানেই উনি থেমে থাকেননি । ঠান্ডা বোঝানোর জন্য আমরা যেমন হাতের তালু দুটি ঘোষি তিনিও ঠিক তেমন করেন । তাতেই দৃশ্যে ঠান্ডা বোঝানো যায় । আসলে তখন খুব গরম ছিল । এই বিষয়তেই উনি বুঝিয়ে দেন যে তিনি কত বড় মাপের অভিনেতা ।"
লীনা গঙ্গোপাধ্যায় নানা কথার মাঝখানে বলে উঠলেন সন্তুবাবুর খাদ্যরসিকতার কথাও, "খুব খেতে ভালোবাসতেন । তবে খাওয়া-দাওয়ায় বিধিনিষেধ ছিল । আমরা স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে বলতাম তাঁকে । কিন্তু, শুনতেন না ।"
লীনার ব্যক্তিগত অভিমত সন্তু মুখার্জির সঠিক মূল্যায়ন হয়নি । বলন, "তবে এটাও ঠিক, সন্তুবাবুর মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয়নি । উনি যত বড় অভিনেতা, সেই জায়গায় সেই দাম উনি পাননি । এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এই স্তরের একজন অভিনেতার আরও অনেক বেশি পাওয়ার কথা ছিল । যে সময়ে এসে তিনি পড়েছিলেন, চারপাশে প্রচুর তারকা । সেই তারকার ভিড়ে তিনি খানিকটা ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন । আমি কথা বলে যা বুঝেছি, এই নিয়ে সন্তুদার ভিতরে অভিমানও ছিল খুব ।"
সন্তু মুখার্জি নাকি ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলেন । একটি চিত্রনাট্যও তৈরি করেছিলেন । সেকথা লীনাকে জানিয়েছিলেন তিনি । এ প্রসঙ্গে লীনা বলেন, "একবার একটা ছবির স্ক্রিপ্ট তৈরি করে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন । সেটা একটা চমৎকার স্ক্রিপ্ট । সেই ছবিটা পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন । এটা কেউই জানেন না হয়তো । আমাকে স্ক্রিপ্টটা পড়ে শোনান । সব আধুনিক সংলাপ । মনে হয়েছিল যেন এই সময়ের কোনও যুবক লিখেছেন । জিজ্ঞাসা করেছিলাম কবে ছবি তৈরি করছেন । আমি মাঝে মাঝেই খোঁচাতাম ছবিটা নিয়ে । তারপর একটা সময় বলেছিলেন ওটা করবেন না । সেই স্ক্রিপ্টটা খুব মিস করি । স্বস্তিকারা নিশ্চয়ই সেটাকে যত্ন করে রেখেছে । সেটা নিয়ে কখনও ছবি তৈরি করতে পারি ।"