পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

By

Published : May 1, 2019, 4:19 AM IST

ETV Bharat / sitara

'মুকুটটা তো পড়ে আছে, রাজাই শুধু নেই'

আজ বেঁচে থাকলে বয়স হত ১০০ বছর। ভারতের প্রবাদপ্রতিম সংগীত শিল্পী মান্না দেকে ETV Bharat-এর শ্রদ্ধা।

মান্না দে

সেই যে বছর জালিয়ানওয়ালা বাগে ইংরেজ সৈন্যরা ম্যাসাকার করল এবং প্রতিবাদে কবিগুরু নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করলেন, সেই একই বছর, অর্থাৎ ১৯১৯ সালের ১ মে বাংলার কোলে জন্ম নিলেন প্রবোধচন্দ্র দে। সঙ্গীতজগত যাঁকে চেনে মান্না দে নামে। মহামায়া দেবী এবং পূর্ণচন্দ্র দের কোল আলো করে এলেন বাংলার সেই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। আজ বেঁচে থাকলে মান্না দে তাঁর জন্মের শতবর্ষ পালন করতে নিজের বাসভবনে প্রিয়জনদের সঙ্গে।

স্ত্রী সুলোচনা, ছবি সৌজন্যে 'মান্না দে সংগীত অ্যাকাডেমি'



ছোট্ট মান্নার সংগীতের প্রতি আগ্রহ অনেক ছোটো বয়স থেকে। যে বয়সে বাচ্চারা খেলাধূলা নিয়ে মেতে থাকে সেই বয়সে অন্য কোনও দিকে তাদের বিশেষ আগ্রহ থাকে না। কিন্তু এমনটা শোনা যায় যে, মানুষের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটে পরিবারের সান্নিধ্যে এসেই। ছোট্ট মান্নার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছিল। যদিও ছেলেবেলায় মান্না দে বেশ ডাকাবুকো ছিলেন। মারপিট করতেন, কিল-চড়-ঘুষি মারতেন। কুস্তি ও বক্সিং শিখেছিলেন গোবর গুহর কাছে। বাবা-মা দুজনেরই গান-বাজনার প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে। এঁরাই মান্না দেকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাঁকে সঙ্গীতানুরাগী করে তুলেছিলেন খুব ছোটো থেকে। তবে এতটা সহজ ছিল না ব্যাপারটা। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে বলেছিলেন যে, আইন নিয়েই পড়তে হবে মান্না দে কে। উকিল হতে হবে তাঁকে। কাকার এই ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়েই মান্না বলেছিলেন তিনি গায়ক হবেন। এর পিছনে একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

গান বাজনা তো দূর, গান বাজনার ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিল না শিশু মান্নার। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে যখন গান বাজনা করতেন, খেলতে খেলতে মাঝেমধ্যে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে তা শুনতেন। ব্যাপারটি বেশ উপভোগ করতে শুরু করেন। একবার একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়। কাকার সঙ্গে যিনি সংগত করতেন, সেই তবলীয়া গান শেষ করে উঠে যাওয়ার পর, বন্ধ ঘর থেকে আওয়াজ আসে, কে যেন তবলা বাজাচ্ছে। এবং সেই শক্ত বোলটা বাজাচ্ছে, যেটা কি না কিছুক্ষণ আগে বাজিয়েছিলেন সেই তবলীয়া। বাড়িতে সকলে বলাবলি করতে শুরু করে, কে বাজাচ্ছে? ভিতরে ঢুকে জানা যায়, ছোট্ট মান্না দে বাজাচ্ছে সেই কঠিন তবলার বোল। অর্থাৎ, ছোটোবেলাতেই শুনে শিখে নিতে পারতেন কঠিন কঠিন বোল।

সংগীতচর্চার কামরা, ছবি সৌজন্যে 'মান্না দে সংগীত অ্যাকাডেমি'

আর এ সবকিছু লক্ষ্য করতেন কাকা কৃষ্ণচন্দ্র। দেখতেন, গানের উপর বিশেষ আগ্রহ আছে মান্না দের। এত কিছুর পরও গান বাজনার ঘরে ঢোকা বারণ ছিল তাঁর। তবে তিনি দৃষ্টিহীন বলে, মাঝেমধ্যে ডেকে পাঠাতেন ছোট্ট মান্নাকে। বলতেন,"মানা, এটা করো, ওটা করো।" তখনই অনুমতি মিলত ঘরে ঢোকার, নচেৎ নয়। তাছাড়া ছোটোবেলায় মাস্তানি করে বেড়াতেন গোটা পাড়ায়। ক্লাবের হয়ে খেলতে যেতেন। হাত শুরশুর করলে মারামারিও করে আসতেন। ছেলেবেলায় এই ধরনের দস্যি ছিলেন প্রবাদপ্রতিম মান্না।

... স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সময় ইন্টার কলেজিয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিন বছর পর পর। কলেজ ক্যান্টিনে টেবিল বাজিয়ে গান শোনাতেন বন্ধুদের। বন্ধুরাই বলতেন, "তোর এত ভালো গানের গলা, প্রতিযোগিতায় নাম দে।" সেই শুনে মান্না দে বলতেন, " আমার বাড়ি থেকে কিছুতেই করতে দেবে না।" তখন বন্ধুরাই বলে, " চল তোর কাকার সঙ্গে কথা বলি।"

প্রথমে বন্ধুরাই এসেছিল বাড়িতে, তাঁর কাকাকে রাজি করাতে। বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবর গুহর ছেলে মানিক এসে কথা বলেছিলেন মান্নাদের কাকার সঙ্গে। বলেছিলেন, " আংকেল, মানা এরকম গান করে কলেজে, আপনি পার্মিশন দিন প্রতিযোগিতায় গাওয়ার।"

তখন কৃষ্ণচন্দ্র দে সটান বলে দেন, " না, ও তো গান করে না। গান করবে না তো।" কিছুতেই অনুমতি দেননি। বন্ধুরা সকলে ফিরে যান। ফিরে গিয়ে প্রিন্সিপাল আর্কুগার্ট সাহেবকে বলেন, " আপনি একটু বলুন মান্নার কাকাকে। তাহলে একজন ভালো কম্পিটিটর পাবেন।" সেই শুনে আর্কুগার্ট একটা দারুণ চিঠি লিখেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দেকে। সেই চিঠির বয়ান অনুযায়ী, " আমরা জানি না কোন ঝিনুক থেকে মুক্ত বেরোবে। শোনা গেছে, মান্না খুব ভালো গান করে। আপনি প্লিজ় ওঁকে অনুমতি দিন গান করার। ওঁ আমার কলেজের নাম উজ্জ্বল করবে।"

এই চিঠি বাড়িতে আসায় মান্না দেকে জিজ্ঞেস করা হয়, " তুমি গান করবে? তাহলে আজ থেকে গান শিখতে বসো সবকিছু ভুলে গিয়ে। তোমার হাতে মাত্র পনের দিন সময়।" সেই সঙ্গে বলা হল, সব বিভাগে নাম দিতে হবে। রাজি হলেন যুবক মান্না। সেই ঘটনার পর মান্না দের প্রথাগতভাবে গান শেখা শুরু। প্রতিযোগিতার প্রত্যেকটি বিভাগে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। শুধু আধুনিক বিভাগ ছাড়া। সেই বিভাগে তিনি হেরেছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর কাছে। পরপর তিন বছর টানা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন বলে রুপোর তানপুরা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সেই তানপুরা আজও স্কটিশ চার্চ কলেজে রাখা আছে।

কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র তালিমে,ছবি সৌজন্যে 'মান্না দে সংগীত অ্যাকাডেমি'

এই ঘটনার পর কৃষ্ণচন্দ্র আর তাঁকে গান শেখাননি। দেখছিলেন, পরখ করছিলেন, ছেলের উৎসাহ কীরকম। শুধু প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য, নাকি গান শেখার জন্য। মান্না দে পরে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছিলেন, "সেই সময় তিনি গান ছাড়া আর কিছুই জানতেন না, বুঝতেনও না।" সব সময় মনে হত গান করতে হবে। সেটা যেন তাঁর ভিতর থেকে টেনে উপরে আনছে। এমন সময় কাকা তাঁকে আবার দূরে সরিয়ে দেন। গানের ঘরে তাঁর প্রবেশ আবার বন্ধ করে দেন। পরখ করা তখনও থামেনি। সেই পরীক্ষায় পাশ করে ঠিকমতো গান শেখা শুরু মান্না দের। প্রথমে উস্তাদ দবীর খাঁ সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা শুরু করেন মান্না দে।

এমন সময় কৃষ্ণচন্দ্রকে আর কে দেশাই ডাকেন ফিল্মে মিউজিক করার জন্য। ডাক আসে মুম্বই থেকে। প্রথমবার মান্না দের ভাই সুদেবের বাবা প্রণব দে গিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রর সঙ্গে। দ্বিতীয়বার মান্না দে বলেন, " না কাকা, তোমার সঙ্গে এবার আমি যাব।" সেই প্রথম মুম্বইতে যান মান্না দে। গিয়ে উস্তাদ আমান আলি খাঁয়ের কাছে নাড়া বাঁধেন। তালিম নেওয়া শুরু করেন। এর আগে অবশ্য প্লেব্যাকে গান করা শুরু হয়ে গিয়েছে তাঁর। প্রথমে তাঁকে কেউ বাংলায় গান করতে দেননি। কেন না, বাংলায় তখন অনেকেই রাজত্ব করছেন। সেই বাংলায় গান গাওয়ার ইতিহাসও বেশ মজার।

লতা মঙ্গেশকরের জন্য দুটি গানের সুর করেছিলেন মান্না দে। সেই গান লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তিনি তখন মেসে থাকতেন। গৌরীপ্রসন্ন দাদা নন্দ তখন সেই সময়ে মুম্বইতে থাকতেন। এবং সেই নন্দই ছিলেন মুম্বইতে মান্নাদের রুমমেট। ওইখানে বসে রবীন্দ্র সংগীত শোনাতেন মান্না দে। মুম্বইতে ভাইয়ের বাড়িতে বসে মান্না দের রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে বলেছিলেন, "মানা তোমার জন্য দুটি গান লিখেছি। দেখো তো, কাউকে দিয়ে গাওয়াতে পারো কি না!?" সেই দুটি গানের একটি, 'কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো' এবং ' হায় হায় গো, রাশ যায় গো'। এই গান দুটি মান্না দে প্রথম শুরু করেন লতা মঙ্গেশকরের জন্যে। লতা মঙ্গেশকর তাঁকে তিনদিন সময় দিয়ে স্টুডিওতে আসেনি বলে নিজেই গেয়ে দিলেন। এবং সেই থেকে প্রথম মান্না দের বাংলা গান গাওয়া শুরু।

ছবি সৌজন্যে 'মান্না দে সংগীত অ্যাকাডেমি'

১৯৪০ সালে সুরকার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন মান্না দে। শৈলেন রায়ের রচনায় সুপ্রীতি ঘোষের কণ্ঠে মান্নাদের প্রথম সুরারোপিত সঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্র দের সংগীত পরিচালনায় মুম্বইয়ের লক্ষ্মী প্রোডাকশনের প্রথম ছবি "তামান্না"তে সুরাইয়ার সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে জীবনের প্রথম প্লেব্যাক করেন মান্না দে - "জাগো আঈ উষা"। তারপর শংকর রাও ব্যাসের সংগীত পরিচালনায় "রামরাজ্য" ছবিতে প্রথম একক প্লেব্যাক - "ভারত কি এক...।"

এরপরই উস্তাদ অমর আলী খাঁ সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম শুরু করেন। সংগীত পরিচালনার রাজ্যে প্রথম পদক্ষেপ এবং পরবর্তী সাত বছরে হরিপ্রসন্ন দাস, ক্ষেমচাঁদ প্রকাশ, শচীন দেব বর্মন এবং অনিল বিশ্বাসের মতো সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে সহ সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। কবি প্রদীপের রচনায়, শচীন দেব বর্মনের সুরে, "মশাল" ছবিতে "উপার গগন বিশাল" গানটি গেয়ে অসাধারণ সাফল্যের পথ দিয়ে হিন্দি ছায়াছবির জগতে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন মান্না দে। সেটি ছিল ১৯৫০ সাল। সেই একই বছরে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে মুম্বই প্রবাসী মালয়ালি মেয়ে সুলোচনা কুমারণের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় তাঁর।

তারপর "আওয়ারা" ছবিতে গান গাওয়ার সূত্রে রাজ কাপুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সূচনা হয়। ভি শান্তারামের মারাঠি এবং বাংলা ডাবল ভার্শন ছবি "অমর ভূপালী"তে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের "ঘন শ্যাম সুন্দর" দিয়ে জীবনের প্রথম বাংলা গান। "চমকি" ছবিতে সংগীত পরিচালনা করে এককভাবে সংগীত পরিচালনারও শুরু। তারপরের বছরই উস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁ সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা শুরু করেন মান্না দে। পরবর্তীকালে শিক্ষা গ্রহণ করেন গোলাম মুস্তাফা খানের কাছে।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, ছবি সৌজন্যে 'মান্না দে সংগীত অ্যাকাডেমি'

তারপরই বিয়ে করেন মান্না দে। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে কেরল কন্যা সুলোচনা কুমারণকে বিয়ে করেন তিনি। এবং তারপরই "দো বিঘা জমিন" ছবিতে প্লেব্যাকের সূত্রে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব জমে ওঠে মান্না দের। যৌথভাবে যোগদান করেন মুম্বইয়ের ইউথ কেয়ারে। প্রথম বেসিক বাংলা গানের রেকর্ডিংও করেন, "কত দূরে আর নিয়ে যাবে বল।"

তার পরের বছর জীবনের প্রথম বাংলা ছবি "গৃহ প্রবেশ" ছবিতে প্লেব্যাক করেন মান্না দে। তার দু বছর পরই বড় মেয়ে সুরমার জন্ম ১৯ অক্টোবর ১৯৫৬। ছোট মেয়ে সুমিতার জন্ম তার দুবছর পর, ১৯৫৮ সালের ২০ জুন। এই সময়টায় কোনও কাজ করেননি মান্না দে। পুরোটাই কেটেছিল পরিবারের সঙ্গে। তারপর একদিন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় এবং সার্থক জুটি বেঁধে বছরের পর বছর জীবনের জনপ্রিয় গানগুলির সৃষ্টি।

১৯৬২ সালে মান্না দের জীবনে যেন শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রথমে ঠাকুরমা, তার চারদিনের মাথায় বাবা এবং মাসকয়েক পর ২৮ নভেম্বর কাকা, অর্থাৎ সংগীত গুরু কৃষ্ণচন্দ্র দে'র প্রয়াণ ঘটে যায়। তার কয়েক বছর পর সুধীন দাশগুপ্তর সংগীত পরিচালনায় "শঙ্খবালা" ছবিতে উত্তম কুমারের লিপে প্রথম প্লেব্যাক - "কে প্রথম কাছে এসেছি" এবং বাংলা প্লেব্যাকের জগতে অসম্ভব জনপ্রিয়তার শুরু এই ছবির এই গান দিয়েই। তারপর আসে রবীন্দ্র সংগীতের প্রথম "ওগো স্বপ্নসরূপিণী"।

কাছাকাছি, ছবি সৌজন্যে 'মান্না দে সংগীত অ্যাকাডেমি'

এরপর নচিকেতা ঘোষের সংগীত পরিচালনায় "নিশিপদ্ম" ছবিতে "না না না আজ রাতে আর..." ও " যা খুশি ওরা বলে বলুক" গানের মধ্য দিয়ে নেপথ্য গায়কের জাতীয় পুরস্কার পান মান্না দে, ১৯৭০ সালে। রাজকাপুরে "মেরা নাম জোকার" ছবিতে "এ ভাই, জারা দেখ কে চালো" গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক এর জাতীয় পুরস্কার পান পরের বছরই। রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির হাত থেকে পদ্মশ্রী খেতাব গ্রহণ করেন।

তারপর ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় মান্না দের গাওয়া প্রথম নজরুল গীতি রেকর্ড। ঠিক তার দু'বছর পর মধ্যপ্রদেশ সরকার প্রদত্ত লতামঙ্গেসকার পুরস্কারে সম্মানিত হন মান্না দে। ২৩ জানুয়ারি কতিপয় দুর্বৃত্ত কর্তৃক প্রকাশ্য রাস্তায় ছড়ার আঘাতে আক্রান্ত হন এবং সেইসঙ্গে মায়ের মৃত্যু হয়।

এই ঘটনা ঘটে যাওয়ার তিন বছর পর বাংলাদেশের "রেনেসাঁ সাংস্কৃতিক পরিষদ" কর্তৃক প্রদত্ত "মাইকেল সাহিত্য পুরস্কার"এ সম্মানিত হন মান্না দে। ১৯৯০ সালে মিঠুন ফ্যানস এসোসিয়েশন কর্তৃক প্রদত্ত "শ্যামল মিত্র অ্যাওয়ার্ড"এ সম্মানিত হন। এক অনুষ্ঠানে গান গাইতে গাইতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। এবং ৫ ডিসেম্বর মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে বাইপাস সার্জারি হয়। তারপর এইচএমভি ছেড়ে দিয়ে প্যারামাউন্ট মিউজিক ক্যাসেট থেকে গান গাওয়া শুরু করেন মান্না দে।

রূপা গাঙ্গুলির সঙ্গে, ছবি সৌজন্যে 'মান্না দে সংগীত অ্যাকাডেমি'

১৯৯১ সালে পুরীর শ্রী ক্ষেত্রকলা প্রকাশিকা কর্তৃক সঙ্গীত স্বর্ণচূড় উপাধিতে ভূষিত হন মান্না দে। তার দুবছর পর সংগীত জীবনের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষকে স্মরণীয় করে তুলতে কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা লাভ করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে পান কমলা দেবী রায় পুরস্কার। ২০০৩ সালে সংগীত জীবনের ৬০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ১ মে ফের নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানেও সম্বর্ধনা পান মান্না দে। একই বছরে আলাউদ্দিন খাঁ পুরস্কার লাভ করেন। পরের বছর মার্চ মাসে জাতীয় গায়কের সম্মান লাভ করেন তিনি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধিও পান। তারপর ধীরে ধীরে আসতে থাকে অসংখ্য অ্যাওয়ার্ড। ২০০৫ সালে মহারাষ্ট্র সরকার থেকে তাকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। সে বছরই ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণে ভূষিত করেন। পান ওড়িশা সরকারের প্রথম অক্ষয় মহান্তি অ্যাওয়ার্ড। ২০০৭ সালে ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করে দাদা ফালকে অ্যাওয়ার্ড। ২০০৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান ডি.লিট। ফিল্মফেয়ার লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড আসে ২০১১ সালে। সেই একই বছর বঙ্গবিভূষণ উপাধি দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে।

এবং ২০১৩ জীবনের শেষ সম্মান হিসেবে তাঁকে সংগীত মহাসম্মান প্রদান করা হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে। কেননা, সেই বছরই ২৪ অক্টোবর সকলকে ছেড়ে পরলোকগমন করেন ৯৪ বছরের মান্না দে। আজ তাঁর জন্মের শতবর্ষ। মান্না দে মানেই, "কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই"। আজও কফি হাউসের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এই গানটাই প্রথম মনে বেজে ওঠে। তারপর "আমি নিরালায় বসে"। "আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না" - নিজেও ভালো রান্না করতে পারতেন। বাড়িতে মালয়ালি ও বাঙালি রান্নার অদ্ভুত মিশেল থাকত। স্ত্রীর সুলোচনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাত দিন রান্না করতেন মান্না দেও। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বড় একাকী হয়ে গিয়েছিলেন মানুষটি। অঝোরে কাঁদলেন স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে। মান্না দে চলে গেলেন আর একটা যুগের অবসান হল।

মুহূর্ত, ছবি সৌজন্যে 'মান্না দে সংগীত অ্যাকাডেমি'



একটা সময়ের অনুভূতিকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল মান্না দের কণ্ঠে গাওয়া গানগুলি। মান্না দে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, "মাঝে মাঝে ভাবি সত্যিই আমি যতটা দিতে পেরেছি, তার চেয়ে অনেক বেশিই আমি পেয়েছি। আমার স্নেহময়ী মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি, আমার কাকা এবং গুরু কৃষ্ণচন্দ্রের মতো মানুষের কাছ থেকে জীবনের শিক্ষা এবং ভালোবাসা পেয়েছি। ওস্তাদ দীবর খাঁ, উস্তাদ আমান আলি খাঁ, উস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁ এবং অন্যান্যদের কাছে সংগীতের ও-রকম তালিম পেয়েছি, আমার সহযোগীদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছি - এ আমার মা-বাবা, আমার কাকা এবং গুরুদের আশীর্বাদেরই ফল। এ আমার জন্ম জন্মান্তরের পুণ্য ফলের প্রকাশ। আমি আপ্লুত হয়ে গেছি বারবার। ধন্য হয়েছি বারবার।"

মান্না দে নিজের মায়ের সম্পর্কে বলেছিলেন, "আমি মন্দিরে যাই না। ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। কিন্তু, এটা মানি যে জীবনে অবলম্বন থাকা দরকার। আমার জীবনে সেই মানুষটি আমার মা। আমি চোখ বুজলেই আমার মাকে দেখতে পাই। গান করি যখন মাকে স্মরণ করে গান করি। আমার গড়ে ওঠার সময়ে মায়ের প্রভাব ছিল প্রবল। ছোটোবেলায় মায়ের কাছে বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথের কথা শুনতাম। মায়ের কাছে শোনা সেইসব কথা আমায় এমনভাবে প্রভাবিত করেছিল যে গোটা জীবনে আর কেউ করেছে বলে আমার মনে হয় না।"

ছবি সৌজন্যে 'মান্না দে সংগীত অ্যাকাডেমি'

তাঁর লেখায় বেরিয়ে এসেছে তাঁর উপলব্ধির কথা। তিনি লিখছেন, "জন্মজন্মান্তরের কথা উঠল বলেই বলি, প্রথম প্রথম এ-দেশের কাজের পরিবেশ দেখে, নানান দুর্জনের অসাধুতা এবং দুরভিসন্ধি দেখে মাঝেমাঝেই ভাবতাম, এই দেশে আর যেন না জন্মাতে হয় আমায়। এই দেশে আর নয়। কিন্তু এখন এই পরিণত বয়সে আমি আমার মত বদল করেছি। আমি চাই আবার এই দেশেই জন্মাতে, আমি চাই আবার আমার মায়ের মতো মা পেতে, কাকার মত কাকা এবং গুরু পেতে। আবার আমি গান গাইতে চাই প্রথম থেকে। আবার ফিরে পেতে চাই সেই সব হারিয়ে যাওয়া গীতিকার, সুরকারদের। আবার আমি ফিরে পেতে চাই আমার প্রিয় শ্রোতাদের, বন্ধুদের, হিতৈষীদের, ভক্তদের। এদের ভালবাসার টানে আবার আমি জন্ম নিতে চাই আমার এই দেশেই, এই সবুজ সুরেলা প্রাণ ভরা ভালোবাসার দেশেই। বারবার প্রতিবার।"

ABOUT THE AUTHOR

...view details