কলকাতা : "নিজের কাজ নিয়ে আমি সবসময়ে সংশয়ে থেকেছি....", যে মানুষটা বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র দুনিয়ার অন্যতম স্তম্ভ, যে মানুষটার জ্ঞান-পরিধি-অভিনয়-লেখালেখি সহ আরও অনেককিছু আর্কাইভ করে রাখার মতো, যিনি তাঁর জীবদ্দশায় যে কত কাজ করে গেছেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই, সেই মানুষটি নিজের কাজ নিয়ে সংশয়ে থাকতেন । এমন না হলে কি আর মানুষ আকাশ ছুঁতে পারে ? উপরের কথাগুলো বলেছিলেন কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ছবি-নাটক ইত্যাদির সংখ্যা কড় গুনে শেষ করা যাবে না । ফেলুদা থেকে শুরু করে 'চারুলতা', 'অশনি সংকেত' থেকে শুরু করে 'অরণ্যে দিনরাত্রি', একদিকে 'ঝিন্দের বন্দী', অন্যদিকে 'গণদেবতা', 'পরিণীতা'..একটু বয়স বাড়ার পর 'অসুখ', 'পারমিতার একদিন', 'বেলাশেষে'..না, এই তালিকা খুব সহজে শেষ হওয়ার নয় । শুধু ছবিতে অভিনয় নয়, পরিচালকের আসনেও বসেছেন সৌমিত্র । সেই ছবির নাম ছিল 'স্ত্রীর কি পত্র', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'স্ত্রীর পত্র'র কাহিনী অবলম্বনে তৈরি করেছিলেন ছবিটি । তবে সৌমিত্রর প্রতিভা তো শুধুমাত্র অভিনয় বা পরিচালনাতেই নয় । তাঁর ব্যাপ্তি সুদূর প্রসারিত । মঞ্চে, সিনেমায়, কবিতায়, ক্যানভাসে, আবৃত্তিতে, সর্বোপরি মানুষের মননে রয়েছেন সৌমিত্র ।
ছেলেবেলা ও মৃত্যুঞ্জয়
শিয়ালদহ স্টেশনের খুব কাছে মির্জাপুর স্ট্রিট, যার বর্তমান নাম সূর্য সেন স্ট্রিট । সেই মির্জাপুর স্ট্রিটেই,জন্ম ছোট্ট পুলুর । সেই থেকে কলকাতার সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান । তবে জীবনের প্রথম 10 বছর তিনি কাটিয়েছেন মফঃস্বলে । নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরটি পুলুকে ধীরে ধীরে সৌমিত্র হতে শিখিয়েছে । সেখানেই মৃত্যুঞ্জয় শীলের সঙ্গে আলাপ, বন্ধুত্ব ও নাট্যচর্চা । সৌমিত্রর বাবা ছিলেন উকিল মানুষ । সরকারি চাকরি করতেন । সেই সময় কৃষ্ণনগরের নাটকের বিরাট নামডাক । অগুনতি নাট্য কম্পানি প্রায় রোজই তৈরি হচ্ছে সেখানে । সেরকমই একটি নাট্যদলের প্রেসিডেন্ট সৌমিত্রর ঠাকুরদা । কৃষ্ণনগরই প্রথম অভিনেতা সৌমিত্রকে আবিষ্কার করে । স্কুলের নাটকে হাতেখড়ি । সেখানেই স্টেজে তাঁর দাপট দেখে সকলে বিস্মিত হয়ে যান । তবে অভিনতা হওয়ার সিদ্ধান্তটা স্কুল জীবনের শেষলগ্নে পৌঁছে নেন সৌমিত্র । সেই সময়ে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব মৃত্যুঞ্জয় শীল । বলা হয়, এই মৃত্যুঞ্জয়ের কারণেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো এক নক্ষত্রকে আবিষ্কার করতে পেরেছিল বাংলার বিনোদন জগৎ । একসময় থিয়েটারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় । কিছু ব্যক্তিগত কারণে কোনও একটি নাটক করতে না পারায়, বন্ধু সৌমিত্রর নাম সুপারিশ করেছিলেন তিনি । ব্য়াস, সেখান থেকেই শুরু ।
সৌমিত্র ও সত্যজিতের পুরোনো অ্যাপার্টমেন্ট
সৌমিত্রর শুরুটা ছিল একেবারে সাদামাটা, সাধারণ । হাওড়ার সরকারি জেলা স্কুলে লেখাপড়া করা, সিটি কলেজে বাংলা অনার্স পড়া এক নিপাট সাধারণ যুবক । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়ার সময় সত্যজিৎ রায়ের 3 নম্বর লেক টেম্পল রোডের পুরনো অ্যাপার্টমেন্টে ছিলেন তিন বছর । সেসময় বাংলা থিয়েটারের অন্যতম অভিনেতা অহিন্দ্র চৌধুরী সৌমিত্রর শিক্ষাগুরু ছিলেন । যাঁরা মনে করেন, অভিনয় শেখার বিষয় নয়, তাঁদের জেনে রাখা দরকার এই ঘটনাগুলো । একদিকে সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে ঠাঁই, অন্যদিকে অহিন্দ্র চৌধুরীর কাছে তালিম । এভাবে চলতে চলতে একদিন জীবনের মোড় ঘোরানো দিনটা এল । বাংলা থিয়েটারের লেজেন্ড শিশির ভাদুড়ীর একটি নাটক দেখতে যান সৌমিত্র । আর এই মানুষটিই পথপ্রদর্শক হয়ে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন । সেদিনের সেই নাটক দেখে জীবনে দুটি পরিবর্তন হয় সৌমিত্রর । এক, অভিনয় ঠিক কোন মাত্রায় পৌঁছতে পারে, সেটা বুঝেছিলেন তিনি । দুই, এই শিশির ভাদুড়ীই সেদিন সৌমিত্রর মনকে আরও দৃঢ় করেছিলেন.. জীবনে কিছু হলে, অভিনেতাই হবেন, স্থির করেছিলেন সৌমিত্র । শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তাঁকে নিজের পরম গুরুর আসনে বসিয়েছিলেন অভিনেতা । এরকম চলতে চলতেই একদিন হঠাৎ অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে ঘোষকের চাকরি পাকা হয়ে যায় চাটুজ্জে মশাইয়ের ।
রেডিয়ো ছেড়ে অপুর আবির্ভাব
অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে কাজ করার সময় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে সৌমিত্রর । সত্যজিৎ রায় তখন 'পথের পাঁচালী' তৈরি করে ফেলেছেন । মানিকের কাজ ততদিনে সাড়া ফেলে দিয়েছে টলিগঞ্জে । সবাই বলছে, ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে নতুন নক্ষত্রের জন্ম, যে কিনা পালটে দিতে পারে চলচ্চিত্রের ভাষা । সাল 1956, অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবি 'অপরাজিত'র জন্য অভিনেতা খুঁজছেন সত্যজিৎ । সৌমিত্র গেলেন সত্যজিতের কাছে অভিনয়ের দরখাস্ত নিয়ে । মনে বড় সাধ, অপুর চরিত্রটা যদি পাওয়া যায় ! সেই সাধ পূর্ণ হলো না । 'অপরাজিত'র অপু হতে গেলে, বয়স আর একটু ছোটো হতে হবে । আসলে কিশোর অপুকে খুঁজছিলেন মানিকবাবু । সৌমিত্র তো তখন যুবক । দরখাস্ত বাতিল হল । তখন সৌমিত্রকে আরও এক প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হতে হয়েছে । কার্তিক চট্টোপাধ্যায়ের 'নীলাচলে মহাপ্রভু' ছবি থেকে নাকচ হয়েছেন তিনি । তবে তাঁকে মনে ধরেছিল সত্যজিতের । দু'বছর পর ফের তলব । 'অপুর সংসার' তৈরি করবেন বলে ঠিক করেছেন পরিচালক । যুবক অপুকে খুঁজছিলেন । বলা ভালো, সৌমিত্রকেই খুঁজছিলেন । ব্যাসে, চাকতি চাকতি মিলে গেল । তারপরটা ইতিহাস । সৌমিত্রর লেজেন্ড হয়ে ওঠার পিছনে মানিকবাবুর অবদান সম্পর্কে অবগত সকলেই ।
মানিক-সৌমিত্র অটুট জুটি
'অপরাজিত'তে কাজ করতে পারলেন না তো কী হয়েছে, সত্যজিৎ রায়ের শুটিং ফ্লোরে প্রায়শই চলে যেতেন সৌমিত্র । 'জলসাঘর'এর শুটিংয়ে গেছেন । তখনও জানেন না, 'অপুর সংসার'এর জন্য তাঁকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন সত্যজিৎ । শুটিংয়ের শেষে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন, সৌমিত্রই আগামী অপু । এই কথা শুনে সৌমিত্র একেবারে অবাক ।