পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / opinion

ঋণের ফাঁদে ফেলা চিনের কূটনীতি - ladakh face off

নানা মহল থেকে ভেসে আসা অভূতপূর্ব সমালোচনার মুখে পড়েছে চিন প্রজাতন্ত্র । কারণের তালিকায় রয়েছে হংকং, তিব্বত, শিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন । ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা, সম্প্রতি নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের প্রবণতা এবং অতি অবশ্যই নানা দেশকে তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলার কূটনীতি ।

china
china

By

Published : Jul 12, 2020, 11:30 AM IST

নানা মহল থেকে ভেসে আসা অভূতপূর্ব সমালোচনার মুখে পড়েছে চিন প্রজাতন্ত্র । কারণের তালিকায় রয়েছে হংকং, তিব্বত, শিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন । দক্ষিণ চিন সাগরে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, বিশ্বের একাধিক অগ্রণী দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে বিবাদ, কোরোনা ভাইরাস নিয়ে তথ্যের অপব্যবহার, বহু আলোচিত BRI (বর্ডার রোড ইনেশিয়েটিভ) । ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা, সম্প্রতি নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের প্রবণতা এবং অতি অবশ্যই নানা দেশকে তাদের ঋণের ফাঁদে ফেলার কূটনীতি । এইসব কিছুই চিনের সঙ্গে ক্রমশ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের দূরত্ব তৈরি করছে ।

‘ডেব্ট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’ শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন প্রখ্যাত জিও স্ট্র্যাটেজিস্ট ও লেখক ব্রহ্মা চেনানি । 2010 -র গোড়ার দিকে । প্রথমদিকে এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হত চিনের তরফে আফ্রিকার দেশগুলিকে, তাদের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য ঋণদানের কূটনীতি ব্যাখ্যা করতে । তবে বর্তমানে বিশ্বের দেশগুলিকে চিনের তরফে ঋণ দেওয়া বোঝাতে এর ব্যবহার হয় । আসলে, ঋণ দিতে চিন দেশগুলির উপর কিছু শর্ত আরোপ করে, যার মাধ্যমে ঋণ গ্রহণকারী দেশগুলি থেকে তারা বড়সড় সুবিধা হাসিল করে । এবং পরবর্তীকালে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সেইসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে । যে পদ্ধতি এবং যে শর্ত চাপিয়ে চিন এই কাজ করে, তাকেই এর ‘ডেব্ট ট্র্যাপ ডিপ্লোমেসি’ বলে ।

এটা কীভাবে কাজ করে?

LIDC (লো ইনকাম ডেভলপিং কান্ট্রিস)-এর অন্তর্ভুক্ত দেশ যাদের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের রূপায়ণের জন্য বিশাল অর্থ সাহায্য দরকার, কিন্তু প্রকল্প রূপায়ণ, ঋণ পরিশোধ করা এবং গোটা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা-সহ কঠোর নিয়মনীতির জন্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংগঠনগুলির কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পায় না-চিন তাদের হাতেগরম ঋণ দেয় । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই LIDC চায়, বিদেশি সংস্থা তাদের অর্থ সাহায্যও করুক আর এখানেই আর্বিভাব ঘটে চিনা সংস্থাগুলির । উৎপাদন এবং রপ্তানি নির্ভর নিজেদের অর্থনীতির দৌলতে চিন সরকার, ব্যাঙ্ক এবং বেসরকারি আর্থিক সংগঠনগুলি এই সব সংস্থাকে তহবিল প্রদান করে সেই সব প্রকল্পের জন্য ‘বিড’ করতে (দর হাঁকতে) যেখানে সুদের হার বেড়ে কখনও কখনও ছয় শতাংশের মতো হয় । যদিও আন্তর্জাতিক সংগঠন যেমন IMF, বিশ্বব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে এই হার থাকে তিন থেকে চার শতাংশ । আর এখান থেকেই খেলা শুরু হয় । ঋণগ্রহণকারী চিনা সংস্থা, ব্যাঙ্ক অথবা বেসরকারি আর্থিক সংগঠনগুলি ক্ষতিপূরণ তথা বন্ধক হিসাবে জমি, খননে ছাড়, হাইড্রাকার্বনে বা বাণিজ্যের সুবিধা চেয়ে নেয় । বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে এই চাহিদা নানা ধরনের হয় । সাধারণত, আর্থিক সাহায্যকারী চিনা সংস্থাগুলি প্রকল্পের রূপায়ণের জন্য অস্বাভাবিক উচু দর হাঁকে । কিন্তু যেহেতু এরা নিজেদের সঙ্গে জরুরি তহবিলও নিয়ে আসে এবং সহজেই স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলে তাই মুক্ত, স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বাণিজ্যনীতির যথেচ্ছ অবহেলা করে সহজেই প্রকল্পটি হাতিয়ে নেয় ।

তাছাড়াও চিনা সংস্থাকে প্রকল্পের বরাত দেওয়ার সঙ্গে আরও কিছু শর্ত জড়িয়ে থাকে । যেমন, সেখানে চিনা সরঞ্জাম, প্রকল্পে চৈনিক নজরদারি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিনা শ্রমই নিয়োজিত হবে । এইভাবে প্রকল্পের ব্যয়ের একটা বড় অংশ যা ইতিমধ্যেই বেশ চড়া হয়ে পড়ে, চুক্তিকারীর কাছে ফেরত আসে । ঋণগ্রহণকারী দেশ যদি সময়ে এই ঋণের সম্পূর্ণ অঙ্ক বা নিদেনপক্ষে কিস্তিও পূরণ করতে না পারে তাহলে বন্ধক বাজেয়াপ্ত করা হয় । গোটা প্রক্রিয়াটি অনেকটা ভারতের গ্রামে গ্রামে চলা মহাজনী কারবারের মতো । কিছু বিশ্লেষকের মতে, চিন সাধারণত এই ধরনের সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনে যুক্ত থাকে না কিন্তু এ ধরনের চুক্তির অস্বচ্ছ্বতা, বারবার খরচ বেড়ে যাওয়া, মাঝপথে চুক্তিকারীর প্রকল্প ছেড়ে চলে যাওয়া এবং বন্ধক বাজেয়াপ্ত করা—–এই সবকিছুই চিনের ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় ।

হোয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, চিন এখনও পর্যন্ত 152টি দেশকে 1.5 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (ভারতের GDP—র প্রায় অর্ধেক) ঋণ দিয়েছে । কিন্তু কিয়েল ইনস্টিটিউট অফ ওয়ার্ল্ড ইকোনমির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, আমরা যদি উন্নত দেশ থেকে চিনের তরফে ক্রয় করা পোর্টফোলিও ঋণ আর বিভিন্ন জোটসঙ্গী দেশগুলিকে তাদের দেওয়া বাণিজ্য ঋণ এই হিসাবের অন্তর্ভুক্ত করি তাহলে এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় 5 ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ছয় শতাংশ) । এই ঋণগুলি হয় একক আর নয় বহু—আলোচিত চিনা BRI—এর (বর্ডার রোড ইনিশিয়েটিভ) অংশ । এই ঋণের পরিধি কতদূর বিস্তৃত হতে পারে, তা এই সত্যের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, বর্তমানে 12টি দেশে চিনের দেওয়া ঋণ, সেই সব দেশের GDP—র 20 শতাংশেরও বেশি । দেশগুলি হল জিবৌতি, টোঙ্গা, রিপাবলিক অফ কঙ্গো, কিরঘিজস্থান, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া, নাইজার, লাওস, জাম্বিয়া, সামোয়া, মঙ্গোলিয়া এবং ভানুয়াতু । চাপের মুখে পড়ে জিবৌতি চিনকে বিদেশে তাদের প্রথম চিনা সেনা ছাউনি গড়তে অনুমতি দিয়েছে এবং শ্রীলঙ্কাকে তাদের হামবানটোটা বন্দর চিনকে 99 বছরের জন্য লিজ় দিতে হয়েছে । এর কারণ চিনের দেওয়া ঋণে ওই বন্দর তৈরি হয়েছিল কিন্তু কিস্তিতে অন্তত এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সেই ঋণ পরিশোধ করতে শ্রীলঙ্কা ব্যর্থ হয় । তৈল সম্পদে ভরপুর অ্যাঙ্গোলা চিনকে খনিজ তেল প্রদান করে তাদের দেওয়া 43 বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ পরিশোধ করছে । এই অ্যাঙ্গোলার রাজধানী শহর, লুয়ান্ডার পাশে চিন একটি আস্ত শহর গড়ে ফেলেছে, কিন্তু সেখানে কেউ থাকে না । আবার তানজানিয়া, মালয়েশিয়া এবং পাকিস্তানকে তাদের দেশে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ মাঝপথেই শেষ করতে হয়েছে চিনের ঋণ পরিশোধ করতে না পারার ভয়ে । মালয়েশিয়ার একটি প্রকল্পের জন্য ঋণের অর্থে 90 শতাংশ খরচ মেটানো হয়ে গিয়েছিল কিন্তু 15 শতাংশ কাজও শেষ না হতে পারার জন্য সেখানকার মাহাথীর মহম্মদ সরকারকে প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করতে হয়েছিল । পাকিস্তানে CPEC প্রকল্পগুলির ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল 36 বিলিয়ন মার্কিন ডলার কিন্তু পরে তা বাড়তে বাড়তে 64 বিলিয়নে চলে যায় । এখন মনে করা হচ্ছে, তা আরও বেড়ে 80 বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে । অভিযোগ, এই সব প্রকল্পের কাজ হাতাতে চিনা সংস্থাগুলি 2.5 বিলিয়ন ডলারের ঘুষ দিয়েছিল । ঋণ পাওয়ার লোভে আমাদের পড়শি দেশ নেপাল যদি চিনের সঙ্গে তাদের প্রেমপর্ব এখনই না থামায়, তাহলে শীঘ্রই চিনের থেকে তাদের নেওয়া ঋণের অঙ্ক বেড়ে 8 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে, যা নিশ্চিতভাবেই বড় একটা ফাঁদ, যার চিহ্ন ইতিমধ্যেই চোখে পড়তে শুরু করে দিয়েছে । বহু ঋণগ্রহীতা দেশে এই ফাঁদে জড়িয়ে পড়ার যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে ঋণের জন্য অন্যত্র অন্বেষণ করার চেষ্টা করছে ।

চিনের এই দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনার ছায়ায় ভারতের অবস্থান ঠিক কোথায়? আমরাও বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করি আমাদের অনুদান, ঋণদান, সহযোগিতার মাধ্যমে । যদিও আমরা এক্ষেত্রে চিনের উচ্চ হার এবং গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারব না তবে চিনের থেকে দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্কের নিরিখে আমরা অনেক ভালো জায়গায় আছি । যদিও চিনের মতো, ভারতীয় অর্থনীতিও সাম্প্রতিক প্যানডেমিকের জেরে বড়সড় আঘাত পেয়েছ, তবু আমরা এই বিপর্যয়কে সুযোগে পরিণত করতে পারি যদি চিনের বিরুদ্ধে ঋণগ্রহণকারী দেশগুলির মনে জমা হওয়া অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে তাদের মধ্যে কিছু কিছু দেশকে আমরা স্বল্প অঙ্কের আর্থিক মূল্যের ঋণ প্রদান করতে পারি । এতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে আমরা বড়সড় সুফল পেতে পারব ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details