রাগামা (শ্রীলঙ্কা), 20 জুলাই: দিনটা ছিল শুক্রবার ৷ বাড়ি ফেরার পথে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছিল জয়সুমা রথনায়কের (Jaysooma Rathnayake) ৷ সোমবার থেকে গ্যাসের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি ৷ অসুস্থ শরীরেও যতটা সম্ভব লাইনে থাকার চেষ্টা করেছেন ৷ মাঝেমধ্যে বাড়িও যেতে হয়েছে ৷ স্নান, রান্না, খাওয়া সারতে ৷ দুশ্চিন্তায় রাতে ভালো করে ঘুম হত না ৷ খালি মনে হত, তাঁর রেখে আসা লাইন থাকবে তো ? কারও হাতেই যে জ্বালানি নেই ৷ যে কোনও সময়েই তাই 'লাইন চুরি' হয়ে যেতে পারে ৷ অবশেষে গ্যাসভর্তি আস্ত একটা সিলিন্ডার বাড়ি নিয়ে যেতে পারছেন তিনি !
72 বছরের জয়সুমা রথনায়ক শ্রীলঙ্কার রাগামা (Ragama) এলাকার বাসিন্দা ৷ রাজধানী কলম্বো (Colombo) থেকে এই শহরতলির দূরত্ব প্রায় 15 কিলোমিটার ৷ জয়সুমার আর্থিক অবস্থা খুব একটা খারাপ নয় ৷ তাই দেশের চরম দুর্দিনেও দু'বেলা দু'মুঠো অন্নসংস্থান হচ্ছে ৷ কিন্তু, কতদিন এভাবে টানতে পারবেন, তা জানা নেই বৃদ্ধের ৷
জয়সুমা রথনায়ককে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তাঁর ছেলে কাসুন সাঙ্কা রথনায়ক (Kasun Sanka Rathnayake) ৷ ইটিভি ভারতকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কাসুন জানালেন, তাঁর বাবার হার্টের অসুখ রয়েছে ৷ ওষুধ কিনতে জলের মতো টাকা খরচ করতে হচ্ছে ৷ অসুস্থতা নিয়েই দিনের পর দিন গ্যাসের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন তিনি ৷ কারণ, এই কাজ করার মতো বাড়িতে আর কেউ নেই ৷ দেশজুড়ে শুরু হওয়া আর্থিক বিপর্যয়ের (Sri Lanka Crisis) জেরে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন ৷ কিন্তু, কাসুনের অফিস এখনও খোলা ৷ বাজারে পেট্রল অমিল ৷ তাই বাড়ির চারচাকা এবং দু'চাকা, দু'টিই অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে ৷
আরও পড়ুন:Lankan Prez Wickremesinghe: শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট 'প্রধানমন্ত্রী' রনিল বিক্রমাসিংহেই
এই অবস্থায় হেঁটে অফিস যাতায়াত করতে হচ্ছে 40 বছরের কাসুনকে ৷ তাতে সময় লাগছে অনেক বেশি ৷ বৃদ্ধ বাবা ছাড়াও তাঁর দুই বোন রয়েছেন ৷ কিন্তু, তাঁদের সংসার আলাদা ৷ ফলে বাপ-ব্যাটার রান্নাবান্না জয়সুমাকেই সামলাতে হয় ৷ দাঁড়াতে হয় গ্যাসের লাইনেও ৷ কাসুন জানালেন, তাঁদের যে এখনও গ্যাসের সিলিন্ডার কেনার সামর্থ আছে, সেটাই বিরাট 'কপাল' ! কারণ, 13.1 কিলোগ্রামের যে সিলিন্ডার কিনতে কিছুদিন আগেও 1 হাজার 380 এলকেআর (শ্রীলঙ্কার মুদ্রা) খরচ করতে হত, এখনই তারই দাম 4 হাজার 80 এলকেআর !
এমন অবস্থায় আমজনতার অনেকেই ফিরে গিয়েছেন প্রাচীন যুগে ! গ্যাস ওভেনের বদলে কাঠের উনুনে রান্না করছেন তাঁরা ৷ রথনায়ক পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয় ৷ গ্যাসের খরচ করতে হচ্ছে বুঝে-শুনে ৷ টাকা বাঁচাতে বাড়ির বাগান থেকেই কাঠ কুড়িয়ে আনছেন জয়সুমা ৷ আর যাঁদের বাড়িতে বাগান নেই, তাঁরা 300 এলকেআর-এর বিনিময়ে কখনও 1 কেজি 200 গ্রাম, আবার কখনও 2 কোজি জ্বালানি কাঠের প্যাকেট কিনছেন ৷ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, আমজনতার এই দুর্দিনেও কোনও হেলদোল নেই সরকারের ৷ জ্বালানি সঙ্কট মেটানোর নামে পরিবার পিছু মাসে মাত্র 2 লিটার কেরোসিন দিয়েই খালাস তারা !
এদিকে, বাজারে গিয়েও হাতে ছ্যাঁকা খেতে হচ্ছে আমআদমিকে ৷ চাল, আটা, সবজি, মাছ-সবকিছুরই দাম লাগামছাড়া ৷ তার উপর যত দিন যাচ্ছে, বাজারে পণ্যের আকাল তৈরি হচ্ছে ৷ বাঙালিদের মতোই সিংহলিরাও মাছে, ভাতে থাকতেই ভালোবাসেন ৷ তাঁদের ভাষায় চাল হল সাহাল (Sahall) ৷ বিভিন্ন প্রকার চালের মধ্যে সিংহলিদের সবথেকে পছন্দের চাল সাম্বা ৷ যা স্বাদে এবং গন্ধে অনেকটা আমাদের বাসমতীর মতো ৷ কিন্তু বর্তমানে বাজারে সাম্বার আকাল চলছে ৷ অনেক খুঁজে চাল পেলেও তার দাম আকাশছোঁয়া ৷ আগে প্রতি কেজি চালের দাম ছিল 130 থেকে 150 এলকেআর ৷ এখন তা বেড়ে হয়েছে 290 থেকে 300 এলকেআর ৷
শ্রীলঙ্কার বাজারগুলিতে টুনা-সহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের বিপুল চাহিদা রয়েছে ৷ কিন্তু ডিজেল অমিল হওয়ায় সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে পারছেন না মৎস্যজীবীরা ৷ ফলে আগে যেখানে 500 এলকেআর খরচ করলেই হাফ কিলো টুনা পাওয়া যেত, এখন তার দাম অন্তত 1 হাজার 250 এলকেআর ৷ প্রতি কেজি আটার দাম 135 এলকেআর থেকে বেড়ে হয়েছে 335 এলকেআর ৷ 1 কেজি গাজর কিনতে খরচ করতে হচ্ছে 800 থেকে 900 এলকেআর ! আগে লাগত 200 এলকেআর ৷
আরও পড়ুন:Interview: শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের থেকেও খারাপ, উদ্বেগ প্রকাশ সিলোন শিপিং কর্পোরেশনের প্রাক্তন প্রধানের
তবে এত কিছুর মধ্যেও স্বস্তি হল, আপাতত ইন্টারনেট সংযোগ মোটের উপর স্বাভাবিক রয়েছে ৷ ফলে অনলাইনে চলছে সরকারি ও বেসরকারি স্কুলগুলির পঠনপাঠন ৷ কিন্তু ঘাটতি সামাল দিতে প্রতিদিন অন্তত সাড়ে তিন ঘণ্টা বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ রাখা হচ্ছে ৷ উপরন্তু ডিজেল না-থাকায় জেনারেটর চালানোও সম্ভব হচ্ছে না ৷ এই অবস্থায় লোডশেডিংয়ের সময় কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে ইন্টারনেট পরিষেবা ৷ এমনই প্রেক্ষাপটে বুধবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হল দ্বীপরাষ্ট্রে ৷ দায়িত্বে এলেন রনিল বিক্রমাসিংহে (Lankan Prez Wickremesinghe) ৷ কিন্তু এসব নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই আমজনতার ৷ তাঁদের আশঙ্কা, ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বদলে গেলেও রোজের এই দুরবস্থা সহজে বদলাবে না ৷ তাই আরও কঠিন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন কাসুন, জয়সুমার মতো আম সিংহলিরা ৷