বেইরুট, 10 অক্টোবর: অতর্কিতে হামলার পরিকল্পনা খুব কম লোকই জানত ৷ গাজার হামাস গোষ্ঠীর উচ্চারিকারিকরাও এই বিষয়ে কিছু জানতেন না ৷ হাতে গোনা 5 কি 6 জনই ইজরায়েলের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা জানতে পেরেছিলেন ৷ এমনটাই দাবি করলেন, হামাস শীর্ষ নেতৃত্বের অন্যতম নেতা আলি বারাকে ৷
লেবাননের রাজধানী বেইরুটে নিজের কার্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থাকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন তিনি ৷ সেখানে তিনি দাবি করেন, ইরান এমনকী লেবাননের হিজবুল্লার মতো মিত্র দেশের সংগঠনগুলিও ইজরায়েলের উপর হামলার বিষয়ে ঘুণাক্ষরেও জানত না ৷ গাজাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার পরিস্থিতি তৈরি হলে, তখন ইরান এবং লেবাননের হিজবুল্লা হামাসের সঙ্গে যোগ দিতে পারে, এমনটাই কথা ছিল ৷
হামাস গোষ্ঠীর এই উচ্চাধিকারিক আলি বারাকে দীর্ঘদিন ধরে প্যালেস্তাইনের বাইরে লেবাননে রয়েছেন ৷ তিনি আরও জানান, এই আক্রমণের পরিকল্পনার ব্যাপারটা শুধুমাত্র গাজায় হামাসের পাঁচ কি ছ'জন উচ্চাধিকারকের জানা ছিল ৷ কখন কীভাবে হামলা চালানো হবে, সে বিষয়ে হামাসের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীরাও কিছু টের পায়নি ৷ এমনকী প্যালেস্তাইনের হামাস জঙ্গি গোষ্ঠী এই হামলা চালাতে পারে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ৷
ইজরায়েল হামাসের এই যুদ্ধে প্রাণ খুইয়েছে বহু সাধারণ মানুষ আরও পড়ুন: মিশরে পৌঁছলেন ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধে আটকে পড়া 27 ভারতীয়
শনিবারের এই আচমকা হামলার নেপথ্যে ইরানের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে ৷ তবে হামাসের শীর্ষ আধিকারিক এই অভিযোগ অস্বীকার করেন ৷ গত সপ্তাহে বেইরুটে হামাস গোষ্ঠীর একটি বৈঠক হয়েছিল ৷ সেখানে ছিলেন ইরান নিরাপত্তাবাহিনীর উচ্চাধিকারিকেরা ৷ তাঁরা নাকি এই হামলা চালানোয় সম্মতি দিয়েছেন ৷ এই খবরও নস্যাৎ করেছেন বারাকে ৷ তিনি বলেন, "হামাসের মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন কম্যান্ডার আক্রমণের সময়টা জানতেন ৷" তবে অতীতে ইজরায়েলের উপর হামাস গোষ্ঠীর হামলা চালানোয় সাহায্য করেছে ইরান এবং হিজবুল্লা ৷ কিন্তু 2014 সাল থেকে হামাস গোষ্ঠী নিজেরাই রকেট তৈরি করছে ৷ তারা নিজেরাই তাদের জওয়ানদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, জানান বারাকে ৷
আরেকদিকে দীর্ঘদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা ৷ ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন 2020 সালে আরব দেশগুলি এবং ইজরায়েলের মধ্যে জটিলতা কাটাতে মধ্যস্থতা করেন ৷ সেইসময় এই সংক্রান্ত চুক্তি আব্রাহাম অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করেছিল আরব আমির শাহি ও ইজরায়েল ৷ তবে এই চুক্তিতে প্যালেস্তাইনকে একটি পৃথক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টির কোনও উল্লেখ ছিল না বলেই জানা গিয়েছে ৷
ট্রাম্পের অসমাপ্ত কাজটি এগিয়ে নিয়ে যান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৷ সৌদি আরবের সঙ্গে ইজরায়েলের মধ্যস্থতার কাজটি শুরু করেন তিনি ৷ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নিউ ইয়র্কে সেই সংক্রান্ত একটি বৈঠকে করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু ৷ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, এই যুদ্ধের ফলে সেই চুক্তির সময় আরও পিছিয়ে গেল ৷ আর এটাই চেয়েছি প্যালেস্তাইনের হামাস গোষ্ঠী ৷ তারা সুপরিকল্পিত ভাবে এক বছর আগে থাকতে এই যুদ্ধের ছক কষেছিল ৷
আরও পড়ুন: প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল বিবাদের ঘুঁটি সাজাচ্ছে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অঙ্ক
তবে আলি বারেক এই জল্পনাও অস্বীকার করেছেন ৷ তাঁর দাবি, বরং এই 'আল-আকসা অপারেশন'-এর অভিঘাতে হামাসের সদস্যরাই চমকে গিয়েছে ৷ এই প্রসঙ্গে বারাকে বলেন, "ইজরায়েলের এমন অবস্থা হবে, এতে আমরা একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছি ৷ আশা করেছিলাম, ইজরায়েল কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করতে পারবে ৷ আমরা চেয়েছিলাম, বন্দিদের দিয়ে বন্দি ফেরত পাব ৷ আমাদের সৈন্য পেপার টাইগার নিউক্লিয়ার বোমার মতো শক্তিশালী ৷" 1 হাজার হামাস সেনা একটা ছোটখাটো অভিযান চালাবে, এমনটাই পরিকল্পনা ছিল, দাবি করেন হামাসের শীর্ষ নেতা ৷
ইজরায়েল হামাসের এই যুদ্ধে প্রাণ খুইয়েছে বহু সাধারণ মানুষ শনিবার ভোর 6.30 মিনিট নাগাদ ইজরায়েলের উপর আচমকা হামলা চালায় প্যালেস্তাইনের হামাস জঙ্গি গোষ্ঠী ৷ ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের সীমান্তে বেড়া ভেঙে, আকাশপথে প্যারাগ্লাইডারে, এমনকী জলপথেও রকেট ছুড়েছে হামাস ৷ এর পাশাপাশি বন্দুকধারী হামাস জঙ্গিরা সাধারণ ইজরায়েলি নাগরিকদের বন্দি করে নিয়ে গিয়েছে ৷ বাদ যায়নি বিদেশি পর্যটকরাও ৷ এর জবাবে ইজরায়েলও পালটা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ৷ হামাসদের পরাস্ত করতে 30 হাজার ইজরায়েলি সৈন্য নেমেছে যুদ্ধক্ষেত্রে ৷ ইজরায়েল ইতিমধ্যে দাবি করেছে, তারা কয়েকশো হামাস জঙ্গি নিকেশ করেছে ৷ হামাসদের বহু ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ৷
বারাকে অবশ্য জানান, এখনও তাদের হাতে হাজার হাজার যোদ্ধা রয়েছে ৷ গাজাতেই শুধুমাত্র 40 হাজার হামাস সেনা রয়েছে ৷ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে মাত্র 2 হাজার হামাস সেনা যুদ্ধ করছে ৷ তেমন প্রয়োজনে লেবানন, প্যালেস্তাইনের আরও জঙ্গি সংগঠন তাদের সঙ্গে যোগ দেবে ৷ এর মধ্যেই প্যালেস্তাইনের ইসলামিক জিহাদ দাবি করেছে, ইজরায়েল-লেবানন আন্তর্জাতিক সীমান্তে তাদের 4 জন বন্দুকধারীর আক্রমণে 7 জন ইজরায়েলি সেনা জখম হয়েছে ৷ এদিকে ইজরায়েল পালটা দাবি করেছে, লেবানন সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীদের লক্ষ্য করে ইজরায়েল সেনা গুলি করেছে ৷ আর হিজবুল্লা জানিয়েছে, তারা বেশ কয়েকটি রকেট, বোমা নিক্ষেপ করেছে ইজরায়েলে ৷
আলি বারাকে এখন প্য়ালেস্তাইনে হামাস গোষ্ঠীর দায়িত্বে রয়েছেন ৷ তিনি সংবাদসংস্থার কাছে জানান, বহু ইজরায়েলি নাগরিককে বন্দি করেছে হামাস ৷ এদের বদলে ইজরায়েলের কারাগার থেকে সব প্যালেস্তাইন নাগরিকদের মুক্তি দিতে হবে ৷ এমনকী আমেরিকার জেলে বন্দি প্য়ালেস্তাইন নাগরিকদেরও ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানাবে হামাস ৷ তিনি বলেন, "বহু প্যালেস্তাইন আমেরিকায় বন্দি ৷ তাদের মুক্তির কথা তুলব আমরা ৷"
ইজরায়েল ও হামাস গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ জারি ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধের আজ চতুর্থ দিন ৷ প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ ৷ জখম বহু ৷ প্যালেস্তাইনে জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েল ৷ অনিশ্চিত অসংখ্য জীবন ৷ আমেরিকা-সহ বিশ্বের বহু দেশই ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে ৷ এদিকে প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন চলছে আমেরিকা এবং অন্য দেশগুলিতেও ৷ এই পরিস্থিতিতে ইজরায়েল হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ইহুদিদের পবিত্র সাবাথের ভোরে এই হামলার উপযুক্ত মূল্য তারা নিয়েই ছাড়বে ৷ অন্য দিকে হামাসের অন্যতম শীর্ষ নেতা বারাকে বলেন, "এই যুদ্ধের জন্য আমরা সবদিক দিয়ে প্রস্তুত ৷ যতই দীর্ঘ হোক, যুদ্ধ চলবে ৷ গাজার উপর আগ্রাসন বন্ধ না হলে, আমরাও জিওনিস্টদের বাঁচতে দেব না ৷"
আরও পড়ুন: ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি! হামাসের হামলায় ইজরায়েলে প্রাণ গেল 800 জনের, পালটা গাজায় মৃত 500