কিভ (ইউক্রেন), 27 নভেম্বর: নাটক শেষ । অভিনেতারা মঞ্চ ছাড়ছেন ৷ তার আগে অবশ্য তাঁরা চিৎকার করে ওঠেন, "ইউক্রেনের গরিমা !" দর্শকরা লাফিয়ে উঠে পালটা চিৎকার করেন, "বীরদের গৌরব !" অভিনেতাদের কাজ তখনও শেষ হয়নি । ভেসে আসে আরও চিৎকার ৷ রাশিয়ার সমস্ত কিছুকে অভিশাপ দিয়ে ইউক্রেনকে বাঁচিয়ে রাখার শপথ নেওয়া হয় ৷ আরও উল্লাস, আরও করতালি ! কড়া শীতেও একত্রিত হয়ে, সবাই তখন অন্ধকার থিয়েটার হল থেকে বেরিয়ে আসে ৷ জরুরি জেনারেটরে সবে চারিদিক কিছুটা আলোকিত । দর্শকরা একটু একটু করে ইউক্রেনের রাজধানীর কঠিন বাস্তবতার দিকে ফিরে যান - এক সময় আরামদায়কভাবে বসবাসযোগ্য 30 লক্ষের যে শহর, এখন কড়া শীতে জবুথুবু, তার উপর রয়েছে নিত্য লোডশেডিং ও রাশিয়ার মুহুর্মুহু বোমা হামলা (Hardship of Ukraine People)৷
নয় মাস আগে রাশিয়া ইউক্রেনে (Russia-Ukraine War) আক্রমণ করার পর থেকে সম্ভবত এখনই সবচেয়ে কঠিন সময়ে সে দেশের মানুষের ৷ মাতৃত্বকালীন ক্লিনিকের এক কর্মী লিফটে কিছু ক্যান্ডি, কুকিজ, জল এবং ফ্ল্যাশলাইটের একটি ব্যাগ রেখে গিয়েছেন ৷ বিদ্যুৎ না থাকায় ব্ল্যাক আউটে আটকে পড়া প্রতিবেশী যাতে সেগুলি দিয়ে কিছুটা কাজ চালাতে পারেন ৷ তিনি বলেছেন, "আপনি নিচে নামবেন না, আমরা জয়ী হব ।"
লোডশেডিং-এ অন্ধকারে ঢাকা ইউক্রেন থিয়েটারেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন প্যারিস নাৎসি দখল থেকে মুক্ত হয়েছিল, তখন জেনারেল চার্লস ডি গল যে কথাগুলি বলেছিলেন, তা এখন কিভের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে । ফরাসি নেতা বলেছিলেন, "প্যারিস ক্ষুব্ধ ! প্যারিস ভেঙে পড়েছে ! প্যারিসে শহীদ ! কিন্তু প্যারিস মুক্ত !" রাশিয়ার প্রতি ক্ষোভ ছড়িয়ে রয়েছে কিভের সর্বত্র । পডিলের থিয়েটারের দর্শক এবং অভিনেতারা সোভিয়েতের সময়ের বিংশ শতকের ইউক্রেনীয় লেখক ভিক্টর ডোমন্টোভিচের একটি বইয়ের উপর ভিত্তি করে "গার্ল উইথ টেডি বেয়ার"-এর অভিনয়ে সেই ক্ষোভকেই আরও স্পষ্ট করে তুলেছেন ৷ "মস্কো" শব্দটি উচ্চারণ করার সময় অভিনেতারা থুথু দিয়েছিলেন এবং ইউক্রেনীয় ভাষায় একটি অভিশাপ দিয়েছিলেন । দর্শকদের করতালির শব্দে তখন কান পাতা যাচ্ছিল না ৷ সেন্ট্রাল কিভের সিমোনা পিজারিয়াতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একটি ফ্রেম করা ছবির পাশে একটি খড়ের পুতুল এবং পিনের বাটিও শহরের ক্ষোভের কথাই তুলে ধরেছে । কিভ যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ৷
পুতিনের প্রতি ক্ষোভের প্রকাশ লোডশেডিং এখন সেখানে নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা ৷ এই গত সপ্তাহে যখন জলের সরবরাহও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন বাসিন্দারা বাইরের ট্যাপে প্লাস্টিকের বোতল ভর্তি করার জন্য কড়া শীতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন । কেউ কেউ ড্রেন পাইপ থেকে বৃষ্টির জলও সংগ্রহ করেছেন । ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ক্ষমতাকে ভেঙে তছনছ করে দিতে ক্রমাগত তাদের উপর ক্রুজ ও ড্রোন হামলা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে রাশিয়া ৷ কিন্তু তাদের কারণে সাধারণ মানুষ যে কষ্টের সম্মুখীন, তার থেকে বোঝা যায় ইউক্রেনকে মানসিকভাবে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে দিতে চায় পুতিনের দেশ ৷ যাতে ইউক্রেন শান্তি চেয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় ৷
স্বাধীনতার স্বপ্নে অবিচল ইউক্রেন আরও পড়ুন:ফের হামলা রুশ বাহিনীর, দূতাবাসের নির্দেশ ভেস্তে গেল নেহার ইউক্রেন যাত্রা
জীবন-মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে পশ্চিমী অস্ত্রের জন্য দরবার করেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ৷ এখন শীত-অন্ধকার এবং মস্কোর বোমা হামলা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী অস্ত্র ৷ তবে এতকিছুর মধ্যেও লড়াই থামেনি ইউক্রেনবাসীর ৷ কিভ তার আগের কিছু উদ্বেগ থেকে মুক্ত বোধ করছে । পশ্চিমী অস্ত্র ইউক্রেনকে সামরিকভাবে সাহায্য করেছে ৷ চলছে পালটা আক্রমণ ৷ খুব কম রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে ৷
জল তুলতে রাস্তায় ইউক্রেনবাসী প্রবল সমস্যার মুখে ইউক্রেন কিভের মেয়র ভিটালি ক্লিটসকো বলেছেন..কিভের একটি মাতৃত্বকালীন ক্লিনিকে মেরিনা মান্দ্রিগোল প্রসবের জন্য গিয়েছেন । ইউক্রেনীয় বাহিনী এখনও পর্যন্ত যুদ্ধে তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য পেয়েছে খেরসনে ৷ এই মাসে দক্ষিণের শহর খেরসন পুনরুদ্ধার করা হয়েছে ৷ মান্দ্রিগোল একজন খেরসন কাস্টমস অফিসার, তিনি রাশিয়ার দখলদারি থেকে পালিয়েছিলেন এপ্রিলে ৷ 6টি রাশিয়ান চেক পয়েন্ট ও খনন করা ক্ষেত্রগুলি দিয়ে তাঁর পালানোর চাপ তাঁর অনাগত শিশুকন্যাকে প্রভাবিত করবে কি না তা নিয়ে সব সময় তিনি চিন্তায় থাকতেন । 9 নভেম্বর তাঁর কোলে এসেছে মিয়া ৷ মান্দ্রিগোল ডেলিভারি রুম থেকে বেরিয়ে শোনেন, রাশিয়ার সৈন্যরা তাঁর শহর থেকে পিছু হঠছে ৷ দু'দিন পর, মস্কো খেরসনকে ইউক্রেনের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ায় শহরজুড়ে উৎসব শুরু হয় ৷ মিয়ার আগমন এবং খেরসনের মুক্তি একসঙ্গে হওয়ায় একরত্তিকে ভাগ্যবতী বলে মনে করতে থাকেন সবাই ৷ এ ভাবেই একজোট হয়ে এখনও স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর গোটা ইউক্রেন ৷