টেকনাফ (বাংলাদেশ), 6 জুন: সমুদ্রের এমন ঢেউ তারা কেউ কখনও দেখেনি, ভাবেনি ৷ চারদিকে শুধু জল ৷ তার উচ্চতা মানুষ সমান ৷ ঝড় উঠেছে ৷ সেতেরা বেগম চিৎকার করে উঠলেন, "আমাদের নৌকাটা ডুবে যাচ্ছে !" 180 জন যাত্রী বোঝাই নৌকাটা তখন বাংলাদেশের দক্ষিণে অন্ধকারে ৷ শুধু অর্ধেকটা ভাসছে ৷ 2022 সালের 7 ডিসেম্বর রাত 11টা নাগাদ শেষ ফোনে জানিয়েছিলেন সেতারা বেগম ৷
ওই নৌকার সব যাত্রীই রোহিঙ্গা ৷ নৌকাটি তৈরি করেছিলেন জামাল হুসেন ৷ তিনি ক্যাপটেন ৷ একসময় মায়ানমারে তাঁর নিজের ধান জমি ছিল৷ চাষ হত৷ গ্রামের তরুণ নেতা ছিলেন জামাল ৷ এসব 2017 সালের আগের কথা ৷ রোহিঙ্গারা মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ৷ এখানে অস্থায়ী ক্যাম্পই তাদের ঠিকানা ৷ এভাবে জীবন কাটে কী করে ? বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে হিংসার ঘটনা বেড়ে চলেছে ৷
তাই ফের সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবে জামাল হুসেন ৷ নৌকা তৈরি করে তার ছবি ছড়িয়ে দেয় মোবাইলে মোবাইলে ৷ যদি কেউ যেতে চায় ৷ তিনি ইন্দোনেশিয়া নিয়ে যাবেন যাত্রীদের ৷ সেখানে জীবন একটু অন্যরকম, একটু স্বস্তির ৷ নৌকা বড়ো, অনেক জায়গা আছে আর খাবারদাবারও নেওয়া যাবে ৷ সবার দায়িত্ব তাঁর ৷ জামাল একজন সুদক্ষ নাবিক ৷ সমুদ্রের গতিবিধি তাঁর চেনা ৷ তিনি ঠিক ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছে দেবেন ৷
আরও পড়ুন: ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা থেকে রোহিঙ্গা সন্দেহে ধৃত 6
সেতেরা বেগম 11 বছর তাঁর স্বামীকে দেখেননি ৷ স্বামী রশিদ ইন্দোনেশিয়ায় থাকেন ৷ জামালের নৌকার ছবি দেখলেন সেতেরা বেগম ৷ জামালের উপর ভরসা করে দুই মেয়েকে নিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় স্বামীর কাছে যাবেন বলে ঠিক করলেন ৷ সেতেরা বেগমের বাবা কিন্তু ভয় পেলেন ৷ মেয়েকে বোঝালেন, সমুদ্রে ওই নৌকায় ইন্দোনেশিয়া পৌঁছনো সহজ কথা নয় ৷ প্রতিপদে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে ৷
স্বামীকে ছেড়ে আর কতদিন কাটাবেন সেতেরা ? মন মানল না বাবার কথা শুনলেন না তিনি ৷ জামালের নৌকায় উঠলেন সেতেরা ও তাঁর দুই মেয়ে ৷ একজনের বয়স 15 এবং আরেকজনের 18 ৷ সমুদ্রপথে এ ভাবেই হাজার হাজার রোহিঙ্গা তাদের জীবনের ঠিকানা খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন ৷ তাঁরা ঢেউয়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছেন ৷ যেমনভাবে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন সেতেরা বেগম ও তাঁর দুই মেয়ে ৷ জামাল হুসেনের নৌকায় থাকা আরও অনেকে ৷
স্বামী রশিদকে শেষবার ফোন করেন সেতেরা ৷ 44 সেকেন্ড মতো স্থায়ী হয়েছিল সেই কলটি ৷ শেষ কথাটা ছিল "ওহ আল্লাহ, এটা ঢেউয়ে ডুবে গিয়েছে, ঝড়ে ডুবে গিয়েছে ৷" ব্যস ৷ তারপর থেকে রশিদ বারবার ফোন করেছেন ৷ না, স্ত্রী ও মেয়ের খোঁজ পাননি ৷