বারাক ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন অ্যামেরিকা সফলভাবে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (JCPOA) - এর মাধ্যমে ইরানের পরমাণু প্রকল্পের কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । কিন্তু ওবামার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গোটা বিষয়টি কার্যত ভেস্তে দিয়েছেন । বর্তমানে ট্রাম্পের কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে JCPOA-র বোধহয় শেষের শুরু হয়ে গিয়েছে । ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পারমাণবিক চুক্তি থেকে অ্যামেরিকা সরে গিয়েছে । দমন নীতি হিসাবে ইরানের উপর একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে । পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইতিমধ্যে জটিল শিয়া-সুন্নি বিরোধকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি সৌদি আরব ও ইজ়রায়েলের মধ্যে বিরোধকেও ব্যবহার করা হয়েছে । জারেদ কুশনির আমলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একাধিক সদর্থক পদক্ষেপ করা হলেও ইরানের সমস্যা দিন দিন জটিল হয়েছে । তার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট তীব্র হয়েছে । ওই এলাকায় বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনায় ইরানের হাত থাকার অভিযোগ উঠেছে । মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের পাশাপাশি আরও কিছু দেশ যেমন ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, গাজ়া এলাকা, সিরিয়া ও লেবানন অ্যামেরিকার স্বার্থপূরণে সমস্যা তৈরি করছে । অন্যদিকে ইরান প্রশাসনের সঙ্গে একাধিক সন্দেহজনক সামরিক সংগঠন যেমন হামাস, হিজবুল্লা, শিয়া মিলিশিয়া ও হাউথিসের যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ । এই গোষ্ঠীগুলি সর্বদা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে ব্যস্ত ।
অ্যামেরিকা JCPOA থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের পারস্য উপসাগর এলাকায় হারমুজ় প্রণালীতে অস্থিরতা বেড়েছে । এই প্রণালী ওই এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তাই সেখানে অস্থিরতা বাড়ায় আর্থিক সংকটের আশঙ্কা করছে ওয়াকিবহাল মহল । ইতিমধ্যে ওই এলাকায় অ্যামেরিকার ড্রোন ও জাহাজে হামলা, সৌদি আরবের তৈল শোধনাগারে হামলার ঘটনায় নির্দিষ্ট করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয়নি । কিন্তু সেই সব ঘটনার পরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের আল কাদস বাহিনীর প্রধান মেজর জেনেরাল কাসেম সুলেইমানির উপর হামলা চালানো হয় । 27 ডিসেম্বর অ্যামেরিকার এক ব্যবসায়ী জঙ্গি হামলায় নিহত হন । তারপর গত শুক্রবার বাগদাদ বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সুলেইমানির গাড়ির উপর ড্রোন হামলা চালায় অ্যামেরিকা । হামলায় ঘটনাস্থানেই মৃত্যু হয় সুলেইমানির । সুলেইমানি ছাড়াও ইরান সমর্থক সামরিক নেতা আল মুহানাদিও ওই হামলায় নিহত হন । এই ঘটনায় ইরানে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে । মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সংকট চরমে পৌঁছায় । কারণ কোনও দেশের মেজর জেনেরালকে এমনভাবে বিদেশী কোনও রাষ্ট্রের তরফে হামলা চালিয়ে খুন করার ঘটনা অভূতপূর্ব । সুতরাং বলাই বাহুল্য যে ইরান বিষয়টি চুপচাপ মেনে নেবে না । সুলেইমানির উপর অ্যামেরিকার হামলা চালানোর ঘটনায় কূটনীতির অনেক হিসেবই মিলছে না বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল । কারণ ওয়াকিবহাল মহল বলছে, সুলেইমানির উপর এমন সময় হামলা হল যখন ইরান ও অ্যামেরিকা কোনও দেশই যুদ্ধ চায় না । শুধু তাই নয়, দুই দেশই বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন ইশুতে বেড়ে চলা উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করছে । তাই এই পরিস্থিতিতে সুলেইমানির মৃত্যু ইরানের সমস্ত মহলেই তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়েছে । সুলেইমানির শেষযাত্রায় যে পরিমাণ লোকের জমায়েত হয়েছিল তা দেখে সেই ক্ষোভের আঁচ পাওয়া যায় । জমায়েত থেকে সুলেইমানির মৃত্যুর জন্য অ্যামেরিকার উপর প্রতিশোধের দাবিতে স্লোগান ওঠে । প্রতিশোধের বার্তা দিয়ে অনলাইনেও অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে ইরানের বিভিন্ন মহল থেকে বার্তা দেওয়া হয় । ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খামেইনি এবং দেশের অন্য নেতারা অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে চরম প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছেন । এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে আগামী দিনগুলি যে যথেষ্ট সংকটময় হতে চলেছে তা বলাই বাহুল্য । এই সংকটের পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলে ওয়াকিবহাল মহলের আশঙ্কা । তাই নিরাপত্তার খাতিরে ইতিমধ্যে অ্যামেরিকা ইরাকে অবস্থিত তাদের দূতাবাস থেকে সমস্ত কর্মী ও নাগরিককে সরিয়ে নিয়েছে । ইরাকের পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের দেশ থেকে অ্যামেরিকার সমস্ত নাগরিককে চলে যেতে বলা হবে । মধ্যপ্রাচ্যে অ্যামেরিকা এই মুহূর্তে দোলাচলে রয়েছে । অ্যামেরিকা খুব শীঘ্রই আফগানিস্তান ও সিরিয়া থেকে তাদের সেনা সরিয়ে নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে । কিন্তু সুলেইমানির মৃত্যুর পর মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক সংকট চরমে ওঠায় শেষ পর্যন্ত অ্যামেরিকা সেনা সরাবে না কি বাড়তি সেনা ওই এলাকায় মোতায়েন করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ।